পেটে ক্ষুধা আর মুখে তালা হাওরের কৃষকের

হাওরে পানি এসে ক্ষতিগ্রস্ত ফসল (ফাইল ছবি)

‘লোক লজ্জার ভয়ে ওএমএস-এর লাইনে দাঁড়াতে পারি না। কাউরে বলতেও পারি না ঘরে চাল নেই। বললেও কেউ কথা বিশ্বাস করবে না। এমনই অবস্থায় পরিবার নিয়ে দিন কাটাচ্ছি।’ এভাবেই নিজের দুরাবস্থার কথা জানালেন অকাল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আব্দুল আউয়াল। শুধু তিনি-ই নন, হাওরের বেশিরভাগ কৃষকের ঘরের চিত্র কম-বেশি এমনই।

সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার দেওয়লা গ্রামের মধ্যবিত্ত কৃষক আব্দুল আউয়াল। ঘরের সঞ্চিত ধান বিক্রি এবং বেশ কিছু টাকা ধার করে বনুয়া কাচার ঢালা ও লম্বাবিল হাওরে ১৩২ (৩০ শতকে এক কেয়ার) কেয়ার জমিতে বোরো চাষা করেছিলেন। সেই জমির ফসল ঘরে তুলতে পারেননি। চৈত্রের আগাম বন্যায় সব ধান তলিয়ে যায়। অথচ জমি চাষ করতে তিনি ২৪৫ মণ ধানের বিনিময়ে ৭ মাসের জন্য ৪ জন কামলা (কৃষি শ্রমিক) রেখেছিলেন। কামলার মজুরি পরিশোধ করেছেন হালের ৬টি বলদ বিক্রি করে। কিন্তু পরিবারের খরচ চালাবেন কিভাবে। এখনও বছরের ঢের সময় বাকি। তার ১৫ সদস্যের পরিবারের মাসে ৪ মণ চাল লাগে। ঘরে নেই এক ছটাক ধান। এছাড়া ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ রয়েছে। সঙ্গে ঋণের বোঝা। ফলে খরচের হিসাব মেলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।

মধুপুর গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিএ পাস করে চাকরি না করে বাপ-দাদার পেশার হাল ধরেছি। এবারের মতো খারাপ অবস্থা এর আগে কখনও হয়নি। দেড় হাল (১২ কেয়ারে এক হাল ) জমি করে দেড়মণ ধানও ঘরে তুলতে পারেনি। গরিব মানুষ তো সরকারি সাহায্য পায়। আমরা তো এবার তাদের চেয়েও বেশি গরিব। আমাদের অবস্থা এমনই যে, পেটে খিদা অথচ মুখে তালা দিয়ে বসে আছি।’

3

একই গ্রামের চন্দন মিয়া বলেন, ‘সরকার ও জনপ্রতিনিধি সবাই গরিবদের নিয়ে ব্যস্ত। মধ্যবিত্ত কৃষকের কথা কেউ ভাবে না। গরিবের বাঁচার হাজারটা উপায় আছে, মধ্যবিত্তের বাঁচার কোনও উপায় নেই। মধ্যবিত্ত কৃষকের কথাও সরকারকে ভাবতে হবে।’

শাল্লার বাহারা ইউনিয়নের প্রতাপপুর গ্রামের দুলাল চন্দ্র দাস বলেন, ‘সাতহাল হাওরে চারহাল (৪৮ কেয়ার) জমিতে ব্রি-২৯ ও ২৮ জাতের ধানের চাষ করেছিলাম। ফসল ঠিক মতো ঘরে তুলতে পারলে ৮০০-৯০০ মণ ধান উঠতো গোলায়। বিপর্যয়ের কারণে ৯ মণ ধানও তুলতে পারিনি। দেনার দায়, কামলার মজুরি, বছরের খোরাক, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচসহ সংসার চালানোর যাবতীয় খরচের বোঝা এখন মাথার ওপর। কী করবো বুঝতে পাচ্ছি না।’

প্রতাপপুরের উষা রানী দাস বলেন, ‘আমাদের ২০ সদস্যের যৌথ পরিবার। প্রতিদিন ২১ কেজি চাল লাগে। এবছর গোলায় ৭ কেজি ধানও নেই। গরুবাছুর বিক্রি করে কামলা বিদায় করেছি। মহাজনের ঋণ, সংসার ও ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ যোগানোর সামর্থ্য নেই। জমি বিক্রির চেষ্টা করছি, কিন্তু ক্রেতা নেই।’ 

শাল্লা প্রেসক্লাবের সভাপতি বাদল চন্দ্র দাস বলেন, এলাকায় কোনও কাজ নেই। মধ্যবিত্ত কৃষকরা কারও বাড়িতে কাজের জন্য যেতে পারে না। মান-সম্মানের ভয়ে ত্রাণের লাইনে বা ভিজিএফ-এর তালিকায় নাম তুলতে পারে না। এক্ষেত্রে সরকার যদি সহজ শর্তে ঋণ না দেয় তবে বিপাকে পড়বেন তারা।

18052530_1371997579555783_889955035_n

বাহাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিধান চন্দ্র চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কৃষকের অবস্থা দেখে গেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক এখন তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন।

জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, মধ্যবিত্ত কৃষকদের সহযোগিতার জন্য বিশেষ কোনও ব্যবস্থা নেই। সরকার ব্যবস্থা করলে তাদেরকে সহযোগিতা করা হবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, আগাম বন্যা ও ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে সদর উপজেলার ৪ হাজার ৭৩০, দক্ষিণ সুনামগঞ্জে  ৬ হাজার ২৬৭, দোয়ারাবাজারে ৪ হাজার ১০২, বিশ্বম্ভরপুরে ২ হাজার ৭২৯, জগন্নাথপুরে ৪ হাজার ৮৯১, জামালগঞ্জে ৬ হাজার ৪২১, তাহিরপুরে ৬ হাজার ৬৮২, ধর্মপাশায় ১০ হাজার ৫২৫, ছাতকে  ৩ হাজার ৫৮, দিরাইয়ে ৭ হাজার ২৯৯, শাল্লায় ৫ হাজার ৭৯৭ জন মধ্যবিত্ত কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। যেসব কৃষককের ২৫০-৭৪৯ শতক কৃষি জমি রয়েছে তাদেরকে মাঝারি শ্রেণির কৃষক বলা হয়ে থাকে।

জেলায় হালনাগাদ তালিকা অনুযায়ী, ৩ লাখ ৩১ হাজার ৩১৬ জন কৃষক রয়েছেন। তাদের মধ্যে ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও মাঝারি শ্রেণির কৃষক রয়েছেন ২ লাখ ২৩ হাজার ৮০৭ জন।

প্রসঙ্গত, ২৮ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, আগাম বন্যা ও ফসল রক্ষা বাঁধ ভেয়ে জেলার ১৪২টি ছোট বড়ো হাওরের ১ লাখ ৬৭ হাজার হেক্টর জমির কাঁচা ধান পানিতে তলিয়ে যায়। এতে তিন হাজার কোটি টাকার ফসলহানি ঘটে।

/এসটি/