‘ভাড়াউড়া চা বাগানে সেই গণহত্যার দৃশ্য মনে হলেই আঁতকে উঠি’

genocide‘১৯৭১ সালের ১ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ফিনলে টি কোম্পানির ভাড়াউড়া চা-বাগানের দিকে নিয়ে যায়। পরে তাদেরকে একত্র করে গুলিবর্ষণ করা হয়। সেদিন চা বাগানে লাশের পর লাশ পড়ে থাকতে দেখি। ড্রেনের (খাল) মধ্যে দুই-তিন দিন পড়েছিল লাশগুলো। সেই গণহত্যার দৃশ্য মনে হলেই এখনও আঁতকে উঠি। এভাবেই সেদিনের কথা বর্ণনা করছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী কালীঘাট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান পরাগ বারৈ ও ভানু হাজরা ।
১৯৭১ সালে ভানু হাজরার বয়স ছিল প্রায় ২০ বছর। ভাড়াউড়া গণহত্যার মাত্র দুই দিন আগে তার বাবা ফাগু হাজরা মারা যান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে।
ফাগু হাজরা ভারতীয় সেনাসদস্যদের পথ দেখিয়ে মৌলভীবাজারের শেরপুরের দিকে নিয়ে যান। সেখানে দুই পক্ষের গুলিবিনিময়ের সময় পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে মারা যান তিনি। তাকে ঘরের পাশেই সেদিন মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল।
ভানু হাজরা বলেন, ’৭১ সালের ১ মে সাত-আট জনের পাকিস্তানি হানাদের একটি দল দক্ষিণ দিক থেকে এসে চা-বাগানে ঢোকে। প্রথমে চা-বাগানের খালের কিনারে থাকা একজনকে গুলি করে মারে তারা। এরপর গ্রাম পুলিশকে ঘরে ঘরে থাকা পুরুষদেরকে ডেকে আনতে বলে। যারা আসতে চায়নি তাদেরকে বালুচ সেনারা জোড় করে ধরে নিয়ে আসে। এরপর পুলের কাছে (বর্তমান বধ্যভূমির স্থান) সবাইকে নিয়ে গেল। পরে সবাইকে ড্রেনে (খালে) নামিয়ে দুই পাশ থেকে গুলিবর্ষণ করে মারা হলো। আমরা বাগান থেকে গুলির শব্দ শুনছিলাম। সকাল ১০-১১টার দিকে ঘটনাটা ঘটে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনারা সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি খালের মধ্যে লাশের স্তুপ। সেদিন ৪৭ জন চা-শ্রমিক মারা গিয়েছিল। কারও মতে এই সংখ্যা ৫৩। পরে মা ও ভাইকে নিয়ে ভারতে চলে যাই। সেখানে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের কৈইলা শহরের কমলপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর কামানের গোলায় বিদ্ধ হয়ে মা সঞ্চরি হাজরা ও ভাই মনা হাজরা মারা যান।’
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী চা-বাগানের দক্ষিণ লাইনের লালচান হাজরা (৭৩) বলেন, ‘আমি সেদিন বাগানেই ছিলাম। দূরে লেবার লাইনে আগুন জ্বলতে দেখি। এর মাঝে দেখলাম দুজনকে গুলি করছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা। আমি চারাবাড়ির একটি বটগাছের নিচে লুকিয়ে দেখছিলাম। দেখলাম লোকজনকে একত্র করে রাখা হয়েছে। এরপরগুলির শব্দ শুনি। সেদিন আমার অনেক আত্মীয়স্বজন মারা যায়। এ ঘটনা দেখার পর বাগান ছেড়ে চলে যাই।’
ভাড়াউড়া চা-বাগানের বধ্যভূমিতে গিয়ে দেখা যায়, ‘শ্রীমঙ্গল-ভাড়াউড়া সড়কের পাশে হালকা নীল রঙের একটি স্মৃতিস্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় তিন ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দেখে বোঝার উপায় নেই এটি একটি বধ্যভূমি।’
শ্রীমঙ্গল কালীঘাট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান পরাগ বারৈ জানান, ‘১৯৯৬ সালে কালীঘাট ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে স্তম্ভটি বানানো শুরু হয়েছিল। অর্থাভাবে উন্নয়ন করা যায়নি। প্রতি বছর জাতীয় দিবসে এখানে চা-শ্রমিকদের পক্ষ থেকে শহীদদের ফুল দিয়ে স্মরণ করা হয়।’