‘হেমন্তে বাড়ি বড় করি, বর্ষায় ছোট হয়’

হাওরে বাড়ি‘হেমন্তে মাটি কেটে বাড়ি বড় করি। আর বর্ষায় হাওরের পানির ঢেউয়ে  মাটি ভেঙে বাড়ি ছোট হয়ে যায়। বৈশাখের শেষে জ্যৈষ্ঠের শুরুতে হাওর থেকে চাইলাবন (হাওরে জন্মানো লতা) কেটে এনে বাড়ির পাশে লাগাই। তাতেও কাজ হয় না। ঢেউয়ে বাড়ির মাটি ভেঙে যায়।’ এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন হাওরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জামালগঞ্জ উপজেলার হটামারা গ্রামের আজিজুর রহমান (৭৭)।

37099954_1907532255935162_5075078273445134336_nএকই গ্রামের জমিলা খাতুন বলেন, ‘বৈশাখের শেষে ধান কাটা শেষ হয়। তারপর থেকে শুরু হয় বাড়ি বাঁধার কাজ। যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে তারা বাঁশ বা পাথর দিয়ে বসতভিটের চারপাশের প্রতিরক্ষা দেয়াল তৈরি করেন। আর যাদের সামর্থ্য নেই তারা হাওর থেকে চালিয়াবন কেটে এনে বেড়া দিয়ে ঢেউয়ের হাত থেকে ঘরবাড়ি রক্ষার চেষ্ট করেন।’

37102572_1907532202601834_6034379950813872128_nহাওরে বছরের একটা দীর্ঘ সময় পানি থাকে। বিশাল জলরাশির ভেতরে হাওরের গ্রামগুলোকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো দেখায়। বর্ষায় সামান্য বাতাসে হাওর উত্তাল হয়ে ওঠে। বিশাল ঢেউ বসতভিটায় আছড়ে পড়ে মাটি ভেঙে নিয়ে যায়। ফলে ঘরবাড়ির আয়তন ছোট হয়ে যায়। এটি হাওরের নিয়মিত ব্যাপার। হাওরাঞ্চলের মানুষ এসব দুর্যোগ মোকাবিলা করেই বেঁচে আছেন। যে হাওর যত বেশি গভীর সে হাওরে ততবেশি ঢেউ।

হটামারা গ্রামের বাস্তব মিয়া বলেন, ‘চৈত্র মাসে বাড়ি ঠিক করার সময় চারদিকে মাটি দিতে হয়। মাটি যাতে ভেসে না যায় সেজন্য চারদিকে শক্ত কিছু দিয়ে আটকে রাখতে হয়। ১০ শতাংশের একটি বাড়ি বানতে ৫/৬ হাজার টাকা লাগে।

হাওরের বাড়িঘরতাহিরপুর উপজেলার গোলাবাড়ি গ্রামের মাসুক মিয়া বলেন, ‘হাওর এলাকার বাড়ি প্রতি বছর বান্ধন লাগে। নাইলে ঢেউয়ে ধুইয়া মুইছা সাফ কইরা দেয়।’

সোনাবান বিবি বলেন, ‘বড়লোকেরা বাড়ি পাক্কা কইরা বান্তো পারে। গরিবের চাইলাবনই সম্বল। পাকা কইরা বাড়ি বান্ধনের সামর্থ্য বেশিরভাগ মানুষের নেই।’

হাওরে বাড়ি

জুবায়ের আহমদ বলেন, ‘হাওরের গরিব মাইনসের পাকা কইরা বাড়ি বান্ধনের কোনও সামর্থ্য নাই। সরকারি বেসরকারি সংস্থা যদি তাদের গ্রামে স্থায়ীভাবে প্রতিরক্ষা দেয়াল তৈরি করে দেয় তাহলে মানুষের বাড়িরঘর ঢেউয়ের তাণ্ডব থেকে রক্ষা পেতো।’

বর্ষাকালে এমনই পানি থাকে হাওরেহাওর অ্যাডভোকেসি প্লাটফরম (হ্যাপ)-এর যুগ্ম আহ্বায়ক ও হাওর বিশেষজ্ঞ শরিফুজ্জামান শরিফ বলেন, হাওর এলাকার বেশিরভাগ মানুষ গরিব। তারা কৃষিজীবী ও মৎস্যজীবী। তাদের আয়-রোজগার সীমিত। খুব কষ্ট করে সামান্য আয় দিয়ে তারা সংসার চালান। তাদের পক্ষে এত এত টাকা খরচ করে বাড়ির পাশে প্রতিরক্ষা দেয়াল তৈরি করা সম্ভব নয়। এ কাজে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

37013169_1907532182601836_284526684118450176_n

স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী ইকবাল আহমদ বলেন, সরকার এলজিইডির মাধ্যমে হিলিপ প্রকল্পের আওতায় বেশ কিছু গ্রামে স্থায়ীভাবে প্রতিরক্ষা দেয়াল তৈরি করে দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হাওর এলাকার আবহাওয়ায় একটি সূক্ষ্ম পরিবর্তন এসেছে। এর প্রভাবে ঢেউয়ের তীব্রতা কোথাও বেড়েছে আবার কোথাও কমেছে। কিন্তু বরাদ্দ স্বল্পতার কারণে হাওর এলাকার সব গ্রামে স্থায়ীভাবে প্রতিরক্ষা দেয়াল তৈরি করতে পারছে না এলজিইডি। বরাদ্দ বাড়ানো হলে বেশি ঢেউপ্রবণ এলাকায় প্রতিরক্ষা দেয়াল তৈরি করে দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।