সলু মিয়ার মন্তব্য, ‘বান্দেও কামকাজ আগের চেয়ে অনেক ভালা হয়। আগে তো মাইসে (মানুষ) বান্দে মাটি দেওয়ার কথা বইলা চিল্লাচিল্লি করতো, অখন চিল্লানি লাগে না মাটিও ঠিক মতো পড়ে।’ তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওর তীরবর্র্তী মারালা গ্রামের কৃষক ধন মিয়া বলেন, ‘এখন বান্দে মাটি আগের চেয়ে বেশি পড়ে। কিন্তু, সময় মতো বান্দের কাজ শুরু ও শেষ না হওয়ায় কৃষকরা অনেক দুশ্চিন্তায় থাকেন। তাই প্রত্যেক বছর যেন সময় মতো কাজ শুরু ও শেষ হয় সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।’
জামালগঞ্জ উপজেলার হালির হাওর পাড়ের বেহেলী গ্রামের কৃষক আব্দুল মালেক বলেন, ‘পরতি বছর বান (বাঁধ) না দিয়া স্থায়ীভাবে বান্দেও কাজ করলে কৃষকের ও সরকারের উভয়ের উপকার হতো। সরকারের টাকা সাশ্রয় হতো অন্যদিকে কৃষকরা নিরাপদে ধানের আবাদ করতে পারতো।’
দিরাই উপজেলার কালিয়াকোটা হাওরের পাড়ের তীরবর্তী এলংজুড়ি গ্রামের অবসর প্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক ধীরেন্দ্র দাস রায় বলেন, ‘সব হাওরের কিছু কিছু জায়গায় স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ করা যায়। স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ করলে প্রতিবছর বাঁধ নির্মাণে এতো টাকা সরকারের খরচ হতো না। অন্যদিকে বাঁধকে রাস্তা হিসেবে জনগণ ব্যবহার করে বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করতে পারতেন।’
উজান তাহিরপুর গ্রামের কৃষক রুস্তম আলী বলেন, ‘হাওরের জাঙ্গালগুলো পাকা করলে অকাল বন্যায় পানি প্রবেশের ঝুঁকি অনেক কমে যেত। জাঙ্গাল (পানি প্রবেশের অ্যান্টি পয়েন্ট) দিয়ে হাওরে পানি প্রবেশ করে।’ চন্দ্রসোনারথাল হাওরের ৭৭ নম্বর পিআইসির (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) সভাপতি আব্দুল করিম হুকুম বলেন, ‘পিআইসি গঠনে বিলম্ব ও এস্কেভেটর (খননযন্ত্র) সংকট ও হাওরের পানি দেরিতে নামার কারণে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যায় না।’
৮১ নম্বর পিআইসির সদস্য সচিব আয়েদ নূর বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ম্যাকানিক্যাল ডিভিশন সুনামগঞ্জে থাকলে বাঁধের কাজ করতে কোনও ধরনের সমস্যায় পড়তো হতো না। কারণ, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এস্কেভেটর আনতে গিয়ে পিআইসিরদের অনেক হয়রানির শিকার হতে হয়। এছাড়া হাওরে মাটি সংকটের কারণে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যায় না।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক বশির আহমদ সরকার বলেন, ‘এ বছর ২ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। এতে ১৪ লাখ মেট্রিকটন ধান উৎপাদন হওয়ার আশা করা হচ্ছে। যদিও শিলাবৃষ্টিতে ফসলের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে।’
জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) প্রিয়াঙ্কা পাল বলেন, ‘উপজেলার বেশ কিছু হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ঘুরে দেখেছি। বাঁধগুলোর অবস্থা বেশ ভালো। তবে, বৃষ্টির জন্য বাঁধে কিছু সমস্যা হয়েছিল। পরে সেগুলো মেরামত করা হয়েছে। আপাতত কোনও সমস্যা নেই।’
এই প্রসঙ্গে সদ্য বিদায়ী জামালগঞ্জের ইউএনও শামীম আল ইমরান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পরপর দুই বছর হাওর রক্ষা বাঁধের কাজে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে পিআইসি গঠন থেকে বাঁধ নির্মাণ সব কাজে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা বজায় রাখার। সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে বাঁধের কাজের কঠিন মনিটরিং করা হয়েছে। সরকারও এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বরাদ্দসহ সর্বাত্মক সহায়তা করেছে।’
সুনামগঞ্জ পুওর (১) পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের অধীনে সদর উপজেলায় ৯টি পিআইসির মাধ্যমে ৩ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় ১৬টি পিআইসের মাধ্যমে ১৫ দশমিক ২৩ কিলোমিটার, তাহিরপুরে ৬৬টি পিআইসির মাধ্যমে ৫৫ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার, ধর্মপাশায় ৮৯টি পিআইসির মাধ্যমে ৬৩ দশমিক ৫৯ কিলোমিটার, জামালগঞ্জে ৫৩টি পিআইসির মাধ্যমে ৬২ দশমিক ৫৬ কিলোমিটার। পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ২ এর অধীনে দক্ষিণ সুনামগঞ্জে ৪২টি পিআইসির মাধ্যমে ৩৮ দশমিক ৩৩ কিলোমিটার, জগন্নাথপুরে ৫০টি পিআইসির মাধ্যমে ৩১ দশমিক ৮২ কিলোমিটার, ছাতকে ৭টি পিআইসির মাধ্যমে ৪ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার, দোয়ারাবাজারে ২৩টি পিআইসির মাধ্যমে ১০ দশমিক ৪৯ কিলোমিটার, দিরাইয়ে ১০২টি পিআইসির মাধ্যমে ৭৪ দশমিক ৫৪ কিলোমিটার, শাল্লায় ৯২ দশমিক ২২ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়।
আরও পড়ুন: স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ আলাদিনের চেরাগ না যে সুইচ টিপলেই হয়ে যাবে: পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী