শুধু কি ফেসবুক পোস্টের জেরেই হিন্দু পাড়ায় হামলা?

শাল্লা উপজেলায় হবিবপুর ইউনিয়নের নোয়াগাঁওয়ে হিন্দুদের বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনা ঘিরে নানা মহলে নানা প্রশ্ন উঠছে। কেউ বলছেন মামুনুল হক বিরোধী ফেসবুক পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে এ হামলা হয়েছে। আবার কেউ বলছেন স্থানীয় একটি জলমহালকে কেন্দ্র করে এ তাণ্ডব চালানো হয়েছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলার পর এসব তথ্য উঠে এসেছে।

স্থানীয়রা জানান, দিরাই উপজেলার সরমঙ্গল ইউনিয়নের ইউপি সদস্য এবং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি শহীদুল ইসলাম স্বাধীন বরাম হাওরের কুচাখাই বিলের ইজারাদার। তিনি বিলের পানি শুকিয়ে মাছ ধরায় ফসলি জমিতে পানির সংকট দেখা দেয়। অবৈধভাবে মৎস্য আহরণ করায় নোয়াগাঁও গ্রামের ঝুটন দাসসহ গ্রামের অনেক কৃষকই ঘটনার প্রতিবাদ করেন। জলমহালে অবৈধভাবে মৎস্য আহরণ ও জলমহালের পানি শুকানোর ফলে চাষাবাদে সেচের পানির সংকটের বিষয়ে নোয়াগাঁওয়ের হরিপদ দাশ ও মুক্তিযোদ্ধা জগদীশ দন্দ্র দাস শাল্লা উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবরে স্বাধীন মেম্বারের বিরুদ্ধে অভিযোগও করেন। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন ইউপি সদস্য শহীদুল ইসলাম স্বাধীন ও একই গ্রামের ক্ষমতাধর অপর ব্যক্তি পক্কন মিয়া।

শাল্লায় তাণ্ডবের মূলহোতা যুবলীগ নেতা স্বাধীন মেম্বার গ্রেফতার

এদিকে হেফাজতের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব গত ১৫ মার্চ দিরাই সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। হেফাজতের এই নেতাকে নিয়ে শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের ঝুটন দাস আপন নামে এক ব্যক্তি গালমন্দ করে ফেসবুকে পোস্ট দেন। স্বাধীন মেম্বার ফেসবুকের ওই পোস্টকে কাজে লাগিয়ে চার গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মীয় উম্মাদনা ছড়িয়ে দেন। ধর্মকে ব্যবহার করে নোয়াগাঁও গ্রামের স্বাধীন মেম্বার তাণ্ডব চালান বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।

শাল্লা উপজেলার হবিবপুর ইউনিয়নের ধারাইন নদের দক্ষিণ পাড়ে নোয়াগাঁও গ্রামের অবস্থান। গ্রামের তিনটি পাড়ায় দুই শতাধিক ঘর আছে। বেশির ভাগ ঘরই টিনের বেড়া ও টিনের চালার। ধারাইন নদের উত্তর দিকে বরাম হাওরের পারে শাল্লা উপজেলার কাশিপুর, দিরাই উপজেলার নাসনি, চন্দ্রপুর ও সন্তোষপুর গ্রাম। ওই চার গ্রামের লোকজনকে নোয়াগাঁও যেতে হয় ধারাইন নদ পার হয়ে। এই নদের উত্তর পাড়ের চার গ্রামের লোকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে জড়ো হন। পরে সেখান থেকে শতাধিক লোক ওই গ্রামে গিয়ে হামলা চালান। তাদের মধ্যে কিশোর ও যুবকের সংখ্যা বেশি ছিল বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়েরের পর আজ পর্যন্ত ৩০ জনকে আটক করেছে পুলিশ। শুক্রবার (২০ মার্চ) দিবাগত রাত ৩টার দিকে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থেকে স্বাধীন মেম্বারকে গ্রেফতার করা হয়। পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ উজ জামান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা-লুটপাটের ঘটনায় মামলা, আসামি ১৮০

তবে দেশজুড়ে আলোচিত এ ঘটনার অন্যতম আসামি পক্কন পলাতক রয়েছে। তার বাড়ি দিরাই উপজেলার সরমঙ্গল ইউনিয়নের নাচনী গ্রামে।

হেফাজতকে পুঁজি করে তাদের নেতৃত্বে এত বড় ঘটনার জন্ম হলো কিভাবে, এ প্রশ্ন এখন স্থানীয়দের মুখে মুখে।

জানা গেছে, অভিযুক্তরা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এমনকি বিলের সঙ্গে জড়িত লোকজনও রাজনৈতিকভাবে সমর্থনপুষ্ট।ইউপি সদস্য স্বাধীননোয়াগাঁও গ্রামের অসিম চক্রবর্তী জানান, স্বাধীন মেম্বার অবৈধভাবে বিল সেচে দীর্ঘদিন ধরে মৎস্য আহরণ করছিলেন। এসবের প্রতিবাদ করায় একটি ফেসবুক পোস্টকে পুঁজি করে হামলার ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

হামলা ও লুটপাটের বিষয় নিয়ে কথা হয় গ্রামের অসংখ্য নারী পুরুষের সঙ্গে। তারা জানান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপন দাস ঝুমনের হেফাজত ইসলামে যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করার পর থেকে গ্রামবাসী অজানা আতঙ্কে ভুগছিলেন। পরিস্থিতি ভালো রাখতে ও সামগ্রিক নিরাপত্তার স্বার্থে গ্রামবাসী ঝুমন দাসকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। তারপরও কেন নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা।

শাল্লায় হামলার ঘটনায় দুই মামলা

কলেজছাত্র রাহুল চন্দ্র দাস বলেন, ঝুমন দাস আপন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপত্তিকর পোস্ট দিয়েছে, গ্রামের সব মানুষতো তা করেনি। তাহলে পুরো গ্রামে কেন এমন হামলা হলো।

রাহুলের মতো স্থানীয় বিবেকবান সবার মনেই এখন এমন প্রশ্ন। তবে সবাই ঘটনার সঠিক তদন্ত ও বিচার দাবি করেন।

প্রসঙ্গত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে বুধবার নোয়াগাঁও গ্রামের ৮৮টি বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়। এ সময় গ্রামের পাঁচটি মন্দির ভাঙচুর করা হয়। ফেসবুকে মাওলানা মামনুল হককে কটাক্ষ করে দেওয়া পোস্টের কথা উল্লেখ করে এই তাণ্ডব চালানো হয়। এ ঘটনায় এক হাজার ৫০০ জনকে আসামি করে থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়। গ্রামবাসীর পক্ষে দায়ের করা মামলার বাদী হয়েছেন, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও গ্রামের বাসিন্দা বিবেকানন্দ মজুমদার বকুল। এই মামলায় ৫০ জনের নাম উল্লেখ করে ও এক হাজার ৫০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। অপরদিকে পুলিশের করা মামলার বাদী হয়েছেন থানার এসআই আব্দুল করিম।