‌‘ওরা আমার মাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি’

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সেজান জুস কারখানার আগুনে নিভে গেছে অনেক তাজা প্রাণ। তাদেরই একজন হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার স্বপ্না রাণী (৩৫)। স্বপ্নার সঙ্গে তার মেয়ে বিশ্বখাঁ রাণীও কাজ করতো ওই কারখানায়। ঘটনার দিন মায়ের নিথর দেহ হাসপাতালে নিয়ে যেতে ও চিকিৎসা নিশ্চিতে অনেকের কাছে সাহায্য চেয়েও পাননি বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্ব খাঁ। 

সেদিনের ভয়ঙ্কর ঘটনার স্মৃতিচারণ করে কিশোরী বিশ্ব খাঁ বলে, চারদিকে আগুন আর চিৎকার শুনে দৌড়ে কারখানার সামনে যাই। সেখানে চারদিকে আহতদের পড়ে থাকতে দেখি। কিন্তু মাকে না পেয়ে পাগলের মতো খুঁজছিলাম। হঠাৎ কারখানার পাশে মায়ের নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখি। মাকে বাঁচাতে হাসপাতালে নিয়ে যেতে তখন অনেকের সহযোগিতা চাই। কিন্তু ওরা কেউ যথা সময়ে এগিয়ে আসেননি। অনেক চেষ্টার পর স্থানীয় হাসপাতালে মাকে নিয়ে যাই। ডাক্তার-নার্সদের বারবার অনুরোধ করেও মায়ের দেহ হাসপাতালের ভেতরে নিতে পারিনি। এক সময় হাসপাতালের বাইরে পড়ে থাকা মায়ের দেহ ডাক্তার এসে দেখে, তবে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। 

নিহত স্বপ্না রাণী নবীগঞ্জ উপজেলার ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের ঘোলডুবা (শ্যামলী) গ্রামের জতি নম’র স্ত্রী।

পারিবারিক সূত্র জানায়, পরিবারের অভাব অনটন দূর করতে ও ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় চলতি বছরের শুরুর দিকে জতি নম স্ত্রী স্বপ্না ও সন্তানদের নিয়ে রূপগঞ্জে যান। সেখানে গিয়ে সেজান জুসের নতুন কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন স্বপ্না ও পুরাতন কারখানায় কাজ হয় মেয়ে বিশ্বখাঁ রাণীর।  

কিন্তু ৮ জুলাইয়ের আগুন কেড়ে নিয়েছে স্বপ্নার প্রাণ। স্বপ্নার মৃতদেহ নবীগঞ্জের ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের ঘোলডুবা (শ্যামলী) এলাকায় বাড়িতে নেওয়া হয়। সেখানে তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। মৃত্যুকালে স্বপ্না পাঁচ সন্তান রেখে গেছেন। তারা হলেন- বাসনা রাণী (১৭), বিশ্বখাঁ রাণী (১৩), মিনতী রাণী (১১), মৌসুমী রানী (৮), জবা রাণী (৪)। স্বপ্নার এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না স্বামী ও সন্তানরা।

স্বপ্নার মেয়ে বিশ্বখাঁ আরও বলে, ‘মা-মা বলে অনেকবার ডেকেছি, কিন্তু আমার মা আর সাড়া দেয়নি। চিকিৎসা দেওয়ার জন্য বড় বড় ডাক্তারের হাতে পায়ে ধরেছি, কিন্তু কেউ সাহায্য করেননি।’

স্বামী জতি নম’র সঙ্গে স্বপ্না রাণীস্বপ্নার স্বামী জতি নম বলেন, পাঁচ সন্তান নিয়ে আমি অসহায় হয়ে পড়েছি। আমি এ ঘটনার বিচার চাই এবং প্রশাসনসহ সবার কাছে আমি সহযোগিতা চাই।

নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মহিউদ্দিন বলেন, স্থানীয় চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় নিহত স্বপ্নার পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করেছি। ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তাদের সহযোগিতা করার যথাসম্ভব চেষ্টা করবো।

প্রসঙ্গত, ৮ জুলাই বিকালে সেজান জুস কারখানায় আগুনের ঘটনা ঘটে। এসময় ছয়তলা কারখানা ভবনটিতে প্রায় চারশ’র বেশি কর্মী কাজ করছিলেন। কারখানায় প্লাস্টিক, কাগজসহ মোড়কিকরণের প্রচুর সরঞ্জাম থাকায় আগুন মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে। প্রচুর পরিমাণ দাহ্য পদার্থ থাকায় কয়েকটি ফ্লোরের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিটের ২০ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। ৯ জুলাই দুপুরে কারখানার ভেতর থেকে ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। আর ঘটনার পরপরই তিন জনের লাশ উদ্ধার হয়। সবমিলিয়ে এ পর্যন্ত ৫২ জন নিহতের তথ্য পাওয়া গেছে। তবে আগুনের ঘটনায় আরও অনেক কর্মী নিখোঁজ রয়েছে। ঘটনা তদন্তে তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।