উপহারের ঘর ছাড়ছে মানুষ: জানে না প্রশাসন

মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহার হিসেবে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য সারাদেশের মতো হবিগঞ্জেও খাস জমিতে সরকারি টাকায় বানানো হয়েছে সারি সারি ঘর। পাকা দেয়াল আর নীল টিনের ছাউনির ঘরগুলো এলাকার সৌন্দর্য বাড়ালেও, এসব ঘরে থাকতে মানুষের অনীহা বাড়ছে।

সুযোগ-সুবিধা এবং নিরাপত্তার অভাব ছাড়াও কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় বেশ কষ্টেই আছে ঘর পাওয়া ২৬টি পরিবার। বাকি ৪৮টি পরিবারের কোনও খোঁজই নেই। ইতোমধ্যে ছয়টি পরিবার তাদের ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের ইকরতলী আশ্রয়ণ এলাকায় কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে। একইসঙ্গে ইকরতলী গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধিকাংশ ঘরের দরজায় তালা ঝুলতে দেখা গেছে।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, দুই একর ছয় শতাংশ খাস জমিতে ৭৪ জন ভূমি ও গৃহহীনকে সরকারি অর্থে বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। একেকটি বাড়ি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে এক লাখ ৭৫ টাকা। প্রতিটি ঘরে রয়েছে দুইটি কক্ষ, রান্নাঘর ও একটি বাথরুম। মুজিববর্ষ উপলক্ষে ২৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাড়িগুলো উপহার হিসেবে উপকারভোগীদের মধ্যে হস্তান্তর করেন।

ইকরতলী আশ্রয়ণ কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, ছয় সারিতে ৭৪টির মধ্যে ২৬টি ঘরে লোকজন বসবাস করছেন। বাকি ৪৮টি খালি পড়ে আছে।

উপকারভোগী ইউনুছ মিয়া জানান, তিনি মূলত উপজেলার বঘাডুবি গ্রামের বাসিন্দা। একসময় রিকশা চালাতেন। কয়েক বছর আগে নিজের পাঁচ শতক ভূমিতে ঘর বানানোর জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন। গত বছরের শেষ দিকে আমুরোড ভূমি অফিস থেকে জানানো হয়, তার নামে ঘরসহ ভূমি বরাদ্দ করেছে সরকার। তাই পাঁচ ছেলেকে সাত শতক জমি দিয়ে নিজে বাড়ি ছেড়ে সরকারি ঘরে আছেন। পরিবারের সদস্যরা বঘাডুবি বাড়িতেই বসবাস করছে।

111(3)

আরেক বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম (২৫) জানান, আগে কালেঙ্গা ফরেস্ট এলাকায় থাকতেন। কাজ করতেন লেবু বাগানে। সারা বছর কৃষি ছাড়া কোনও না কোনও কাজে ব্যস্ত থাকতেন। ইকরতলীর সরকারি ঘরে এসে মাসে পাঁচ দিনও কাজ পান না। কীভাবে দিন পার করবেন ভেবে পাচ্ছেন না বলে জানালেন আমিনুল।

তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের লাইন ঘর পর্যন্ত টেনে আনা হয়েছে।  আবেদনের জন্য ১১৫ টাকা দিতে হয়েছে। দুই হাজার টাকা ফিস দিতে না পারায় সংযোগ পাচ্ছেন না। ঘরে ওঠার আগে বলা হয়েছিলো বিদ্যুৎ সংযোগ ফ্রি পাবো। টাকার অভাবে হতদরিদ্র মানুষ বিদ্যুৎ নিতে না পারায় প্রচণ্ড গরম সহ্য করতে হচ্ছে। রাত হলে ভর করে গভীর অন্ধকার। ভয় করে মা-বোনদেরকে নিয়ে। চার পরিবারের জন্য একটি টিউবওয়েল থাকার কথা। সেখানে ১২টি পরিবার একটি টিউবওয়েলের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। পানি সংকট এখানে চরম। কিছু কিছু ঘরের দেয়ালে ফাটল ধরেছে। যদিও মেরামত করা হয়। বৃষ্টির সময় পানি পড়ে।’

আমিনুল আরও জানান, ভূমি রেজিস্ট্রারের সময় এক হাজার ৬৬০ টাকা নেওয়া হয়েছিলো। অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার খবর জানাজানি হলে সরকারি কর্মকর্তা এসে পরবর্তী সময়ে ২২০ টাকা ফেরত দেয়।

উপহার হিসেবে পাওয়া ঘরে একা থাকেন গার্মেন্টকর্মী তাজ নাহার। ঘরে টিভি ফ্রিজ আছে জানিয়ে বলেন, ‘এক মাস আগে দুর্বৃত্তরা তার ঘরের দেয়াল ভাঙার চেষ্টা করে।’ আশপাশের ঘরগুলো খালি পড়ে থাকায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলেও জানান এক সন্তানের এই জননী।

একই কথা জানালেন কামরুন্নাহার। তার স্বামী ঢাকায় ট্রাকের হেলপার। বাড়িতে একা থাকতে হচ্ছে। রাত হলে ভয় করে।

আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারীরা আরও জানান, কর্মসংস্থানের অভাব এবং হাটবাজার দূরে থাকায় উপহারের বসত ঘরটি বিক্রি করারও চিন্তা করছেন কেউ কেউ।

ইতোমধ্যে বসবাসকারী জবা আক্তার, রহিম মিয়া, সলিমা খাতুন, মাহফুজ মিয়া, মনফর মিয়া ও আবু মিয়া ঘর ছেড়ে চলে গেছেন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, অনেকে ঘরে এক রাত থেকেই চলে গেছেন। কিন্তু ৪১ নম্বর ঘরের ছপিনা খাতুন, ৪৫ নম্বরের নূরুল হক স্বপন, ৫৮ নম্বরের মো. শামসুল হক, ৬৪ নম্বর ঘরের মালিক আব্দুল মোত্তালিব পাঁচ মাস আগে ঘর বরাদ্দ পেলেও একবারও আসেননি।

এ প্রসঙ্গে চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সত্যজিত রায় দাশ বলেন, ‘বিভিন্ন মিডিয়ায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে চুনারুঘাটের সম্মান ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পে সুবিধাভোগীরা ঘর ছেড়েছেন, এমন তথ্য আমাদের কাছে নেই।’