অপসংস্কৃতির কাছে অসহায় বাউলরা

বাউলের রাজধানী নামে খ্যাত সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চল। এখানকার মনোমুগ্ধকর পরিবেশ লোকজনকে বাউল গানের প্রতি সহজাতভাবেই আকৃষ্ট করে। তবে আকাশ সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতির প্রভাবে এই বাউল সম্প্রদায় এখন মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।

আগে হাওর পাড়ের মানুষ ফসল কাটার পর পরই গ্রামে গ্রামে বসতো বাউল গানের মনমাতানো আসর। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে গানের আসর বসিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন বাউলরা। জগত সংসারের প্রতি বৈরাগ্য ভাব থাকায় বাউলরা কোনও মতো ডালভাতের সংস্থান করতে পারলেই খুশি থাকতেন। তবে বর্তমানে শহরে বা গ্রামে কোথাও বাউল গানের আসর বসলে এখন আর তাদের ডাক পড়ে না। আধুনিক বাউলরা প্রকৃত বাউল গানের সুর, সংগীত ও কথা বিকৃতভাবে পরিবেশন করে নেচে গেয়ে দর্শক-শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করেন। অত্যাধুনিক বাদ্যযন্ত্রের কাছে হার মেনেছে হারমনিয়াম, ঢোল, মন্দিরা, বেহলা।

আগে দর্শক শ্রোতাদের আগ্রহ অনুযায়ী বাউলরা বেহালা, হারমোনিয়াম, ঢোল, মন্দিরা বাজিয়ে মালজোড়া, নবীতত্ত্ব, কারবালা, নারী-পুরুষ, রাই-শ্যামধারা, দেহতত্ত্ব, কাদিরিয়া, নকশিবন্দি,শরিয়তী, মারফতি, তরিকত, মাইজভান্ডারী, খাজাবাবার পালা, গাজীকালুর পালাসহ বিভিন্ন লোকগান পরিবেশন করতেন। সন্ধ্যার পরপরই গ্রামের আবালবৃদ্ধ বনিতারা যোগ দিতেন গানের আসরে। রাতভর গান উপভোগ করে ভোরে বাড়ি ফিরে যেতেন একরাশ আনন্দ বেদনার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে। সে সময় মানুষের চাহিদা ছিল কম, তাই বাউলদের পারিশ্রমিকের পরিমাণ তিন অংকের কোঠা পেরুত না। ৫০০ টাকা দিয়েই রাতভর গানের আসর বসানো যেতো। বাদ্যযন্ত্রীসহ পাঁচ থেকে ছয় জনের একটি বাউল দল রাতের খাবার খেতেন গ্রামের কোনও এক বিত্তশালীর বাড়িতে। তাদের আপ্যায়নেরও কোনও ঘাটতি ছিলো না।  গ্রামের লোকজন প্রতিবছরই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে যেতেন যেন পরের বছর অন্য গ্রামের আগে তাদের গ্রামে গানের আসর বসে এটি নিশ্চিতের জন্য। এজন্য কোনও কোনও গ্রামবাসী বাউলদের অগ্রিম টাকাও দিয়ে রাখতেন। এখন আর সে অবস্থা নেই, প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান বিকাশ তাদের রুটি রজিতে ভাগ বসিয়েছে।

বাউল মনির

সেই আক্ষেপের সুর পাওয়া গেছে জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার রামনগর গ্রামের বাউল মনির পাগলার স্বরোচিত গানে। গানে গানে তিনি বলেন, ‘বেকার সমস্যা বিশেষ কাজকর্মও মিলে না গরিবের উপায় কি ভাই বলো না। আমরা গরিব কোলে জন্ম নিলাম ধন-সম্পত্তি নাহি পাইলাম। অভাবে দিন কাটাইলাম সইলাম কতো যন্ত্রনা। গ্রাম যারা ধনী আছে মুচকি মুচকি হাসিতেছে সুদ দিলে কয় টাকা আছে, নইলে টাকা পাবে না।’

ভৌগলিক কারণে হাওরাঞ্চল দুই ভাগে বিভক্ত। ভরা বর্ষায় হাওরের চারিদিকে পানি থৈ থৈ করে। কৃষি কাজ ও মাছ ধরা হলো হাওরবাসীদের প্রধান পেশা। শুষ্ক মৌসুমে চারদিকে থাকে সবুজ ধানের সমারোহ। মাছে-ভাতে বাঙালি বাংলার এ চিরন্তন প্রবাদটি হাওরবাসীর জীবনে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। সুনামগঞ্জ খাদ্যে উদ্বৃত্ত এবং এখানে রয়েছে মিঠা পানির মাছের ভাণ্ডার। হাওরের জলমহালগুলোয় বিপুল পরিমাণ মিঠা পানির  মাছ প্রাকৃতিক ভাবে উৎপাদিত হয়। তাই মাছ ও ভাতের অভাব নেই এখানে। কিন্তু বাউলদের সমস্যা একটাই। এগুলো প্রতিদিন কিনে খাওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই।

সরকারি-বেসরকারি প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে বাউলরা এখন অনেকেই বিকল্প পেশা বেছে নিচ্ছেন। যদিও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একটি বাৎসরিক অনুদান দেয়। তাও সীমিত সংখ্যক বাউলরা পায়। সিংহভাগ বাউল এ অনুদান থেকে বঞ্চিত। অথচ বাউলরা বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতির ভাণ্ডারকে সৃষ্টিশীল রচনা, সুর ও সংগীত দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন। মরমী কবি হাছন রাজা, বৈষ্ণব কবি রাধারমণ দত্ত, শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহ, মকরম শাহ, কফিল উদ্দিন সরকার, কারি আমির উদ্দিন, কালাশাহ, গিয়াস উদ্দিন, কামাল পাশা বিশ্ব দরবারে লোকজ সংস্কৃতি তুলে ধরেছেন।

সুরমা পাড়ের বাউল সংঘের সভাপতি বাউল শাহজাহান বলেন, সুনামগঞ্জের বাউল সম্প্রদায়ের কোনও ভবিষ্যত নেই। জেলার তার মতে ৭৩৬ জন তালিকাভুক্ত বাউল শিল্পী রয়েছেন। যাদের বেশির ভাগের জীবন অভাব আর অনটনের মধ্যে চলছে। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে এখন মোবাইলসহ ছোট ছোট গানের ডিভাইসে বাউল গানের সুর ভেসে আসে না। মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন করে দিয়েছে এই সংস্কৃতি। গ্রামের হাটবাজারে এখন হাত বাড়ালেই মিলে অশ্লীল অশালীন নৃত্য ও গান। এছাড়া ভারতীয় হিন্দি গানের বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে গ্রামগঞ্জে। তাই বাউল গানের প্রয়োজনীতাও ফুরিয়ে এসছে।

তার মতে, আকাশ সংস্কৃতির কারণে সমাজে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বাড়ছে নীতি নৈতিকতার অবক্ষয়। তিনি সরকারের কাছে বাউলদের জন্য মাসিক ভাতা চালু করার দাবি জানান।

বাউল শাহ আবদুল করিমের ছেলে শাহ নুর জালাল বলেন, বাউল শাহ আব্দুল করিমের গানকে পুঁজি করে অনেকেই কোটি কোটি টাকা ব্যবসা করছেন। এমনকি মোবাইলের রিংটোন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে তার গান কিন্তু তিনি রয়্যালিটি আয় বাবদ একটি টাকাও পাননি।

জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন বাউলদের প্রতি খুব আন্তরিক। বছরে একবার সীমিত সংখ্যক বাউলদের ১০ হাজার টাকা করে এককালীন ভাতা দেয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। তবে এ সহযোগিতার হার আরও বাড়ানো বলে তিনি মনে করেন।

সুনামগঞ্জ ৪ আসনের সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বলেন, ‘আরও বেশি সংখ্যক বাউল যাতে ভাতা পায় সেজন্য ভাতা বাড়ানোর বিষয়টি আমি সংসদে উত্তাপন করবো।’