ভেঙে ফেলা হচ্ছে ২০০ বছরের পুরনো মোগল আমলের সেতু

সিলেটের গোলাপগঞ্জের লক্ষ্মীপাশা ইউনিয়নের বাউশা এলাকার দেওরভাগা খালে নির্মিত প্রায় ২০০ বছরের পুরনো ‘দেওয়ানের পুল’ সেতুটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। সেতু পুনর্নির্মাণ ও প্রশস্তকরণ করতে মোগল আমলে নির্মিত সেতুটি ভাঙা হচ্ছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। নতুন সেতু র্নির্মাণ ও প্রশস্ত করতে এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তিন কোটি ৮২ লাখ টাকা। গত কয়েকদিন ধরে সেতু ভাঙার কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। 

এদিকে, ঐতিহ্যবাহী এই সেতু ভাঙায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা। পাশাপাশি ২০০ বছরের পুরনো সেতুটি অক্ষতভাবে সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের নেতারা। বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) দুপুরে সংগঠনটির প্রতিনিধি দল সেতু এলাকা পরিদর্শনের পর এ দাবি জানিয়েছেন। সেতু ভাঙা বন্ধ না হলে বাপার পক্ষ থেকে জনস্বার্থে আদালতে মামলা করা হবে বলে জানিয়েছেন নেতৃবৃন্দ।

জানা গেছে, মোগল শাসনামলের সম্রাট মুহম্মদ শাহের রাজত্বকালে আনুমানিক ১৭৪০ সালে শ্রীহট্ট জেলার (বর্তমান সিলেট) দেওয়ান (রাজস্ব কর্মকর্তা) নিযুক্ত হন গোলাব রাম (মতান্তরে গোলাব রায়)। তখন সিলেট অঞ্চলের ফৌজদার ছিলেন শমসের খান এবং সারাবাংলার শাসনকর্তা ছিলেন সুজা উদ্দিন মুহাম্মদ খান। সনাতন ধর্মাবলম্বী গোলাব রাম ধর্মপ্রাণ ছিলেন। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই এই ধর্মপ্রাণ দেওয়ান বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রীচৈতন্যের পিতৃভূমি দেখতে শ্রীহট্ট থেকে হেঁটে বাউশার কোনাচরে গিয়ে ঝরংবিল-সংলগ্ন বসন্ডার খালে আটকে যান। পরে পার হন নৌকা দিয়ে। এরপর তিনি শ্রীচৈতন্যের পিতৃভূমি দেখতে যান। সেখানে যাওয়ার পর মন্দিরের জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে সেটিও মেরামত করেন। মন্দির দর্শনে ভক্তদের যাতায়াতে যাতে বিঘ্ন না ঘটে সেজন্য একটি সড়ক ও পুল নির্মাণ করেন। আজও এই অঞ্চলের মানুষের কাছে এই সড়ক ও পুলটি দেওয়ানের নাম বহন করে চলেছে। তবে পুলের ওপরের স্থান ব্যবহারের উপযোগী থাকলেও নিচ দিয়ে কোনও ধরনের নৌযান চলাচল করতে পারছে না। দেওয়ানের পুলের দৈর্ঘ্য ২০ ফুট ও প্রস্থ ১৬ ফুট। কয়েক মাস আগে পুলটি ভেঙে সেখানে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় এলজিইডি। এরই মধ্যে হঠাৎ কয়েকদিন আগে থেকে সেতু ভাঙার কাজ শুরু হয়।

উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আগের পুলটি ছিল ২০ ফুট দীর্ঘ ও ১৬ ফুট প্রস্থ। একই জায়গায় এখন ৯৯ ফুট দীর্ঘ ও ৩২ ফুট প্রস্থের সেতু নির্মাণ করা হবে। এজন্য তিন কোটি ৮২ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগামী অর্থবছর সেতুর সংযোগ সড়কটিও প্রশস্ত করা হবে।

উপজেলা প্রকৌশলী মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘দেওয়ানের পুলটি উঁচু ও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এটি মেরামত করা হলেও তেমন কোনও কাজে আসবে না।  ভাঙার আগে কারিগরি কমিটি পরিদর্শন করেছে। তারা বলেছে, এটি রাখলেও টিকবে না। বিকল্প চিন্তা করেও লাভ হবে না। তাই পুলটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে।’

মোগল শাসনামলের সম্রাট মুহম্মদ শাহের রাজত্বকালে সেতুটি নির্মাণ করা হয়

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী ইনামুল কবীর বলেন, ‘দেওয়ানের পুলটি যথাযথ জায়গায় রেখে আরেকটি পুল করা কোনোভাবেই সম্ভব না হওয়ায় ভাঙার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পুলের নিচের অংশ সরু হওয়ায় পানি প্রবাহে সমস্যা হচ্ছে। কোনোভাবেই নদীর ওপর মোগল আমলের ঐতিহ্য রাখা সম্ভব নয়। এছাড়া পুলটি উঁচু এবং অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে। সেজন্য জনস্বার্থে পুলটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলো ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি রাস্তা প্রশস্তকরণসহ অন্যান্য কাজ চলবে। সেতু নির্মাণ ও প্রশস্তকরণ করতে সরকার থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’

লক্ষ্মীপাশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহতাব উদ্দিন বলেন, ‘দেওয়ানের পুল ঐতিহ্যের একটি অংশ। এই পুলটি একেবারেই কাজে আসছে না। সেইসঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য ভেঙে ফেলা হচ্ছে।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘সিলেটে মোগল স্থাপত্য একেবারেই কম। দেওয়ানের পুলটি ঐতিহ্যের একটি অংশ। কিন্তু সরকারি টাকায় সেই ঐতিহ্য ভাঙা হচ্ছে। আমরা বুধবার দেওয়ানের পুল পরিদর্শন করে দেখেছি এখনও ভাঙনের কাজ অব্যাহত রেখেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ অবস্থায় আমরা প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আমরা বলেছি, যদি অনুরোধের পরও এই পুল ভেঙে ফেলা হয় তাহলে জনস্বার্থে আদালতে মামলা করবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর আমাদের জানিয়েছে তাদের পক্ষ থেকে স্থানীয় প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে আপত্তি জানানো হয়েছে। এরপরও যদি পুলটি ভাঙা হয় তাহলে তারাও তাদের মতো আইনি ব্যবস্থা নেবে।’