হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার দিনারপুরে পাহাড় কাটা নিয়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালককে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। কিন্তু আদেশের ১১ সপ্তাহ পার হলেও নেওয়া হয়নি ব্যবস্থা। ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এখনও চলছে পাহাড় কাটার মহোৎসব। প্রশাসন ব্যবস্থা না নেওয়ায় সচেতন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, বছরের অধিকাংশ সময় নবীগঞ্জের দিনারপুর পরগণার পানিউমদা, গজনাইপুর ও দেবপাড়া ইউনিয়নে পাহাড় ও টিলা কাটা হচ্ছে। প্রকাশ্য দিবালোক এবং রাতের আঁধারে অতি সু-কৌশলে পাহাড় কেটে উজাড় করে নিয়ে যাচ্ছে একটি চক্র। গত ১ ফেব্রুয়ারি দিন-দুপুরে এবং রাতভর দেবপাড়া ইউনিয়নের দেবপাড়া বাজারের পার্শ্ববর্তী ইয়াওর মিয়ার বাড়ির উঁচু পাহাড় কেটে স্থানীয় একটি পুকুর ভরাট করেন মাঠ বনগাঁও গ্রামের ওয়াহাব মিয়ার ছেলে সেলিম মিয়া। মাটি কাটায় জড়িত সেলিম ইতিপূর্বে অন্য আরেকটি পাহাড় কাটার মামলার আসামি। ‘টু ব্রাদার’ নামে বাহিনী তৈরি করে ওয়াহাব মিয়ার দুই ছেলে সেলিম ও সিরুল দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে পাহাড় ও টিলা কেটে মাটি বিভিন্নস্থানে বিক্রি করে আসছেন।
অন্যদিকে, গত ২৮ জানুয়ারি দিনারপুরের এক প্রভাবশালী চেয়ারম্যানের যোগসাজশে গজনাইপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুল আলী ও সনর মিয়া, গজনাইপুর গ্রামের হাছন মিয়ার ছেলে অলি মিয়া, তাজুল ইসলামের ছেলে সিরাজ মিয়া উঁচু একটি টিলা ভেকু মেশিন দিয়ে কেটে সমতল করেন। এরপর ২৯ জানুয়ারি দেওপাড়া গ্রামের জামাল মিয়া আরেকটি টিলা কেটে নিকটবর্তী একটি স্থান ভরাট করেছেন। পাহাড় কাটায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে আশপাশের ঘরবাড়ি। এসব বসতভিটা ভারী বর্ষণ হলে ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়।
চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি হিউম্যান রাইটস পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটি সম্পূরক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি হয়। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
আদালতের বরাত দিয়ে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আবেদনের শুনানি শেষে আদালত হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি), পরিবেশ অধিদফতরের বিভাগীয় পরিচালককে দিনারপুর এলাকার পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে চার সপ্তাহের মধ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ১৫ ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন করে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতেও বলা হয়।’
তবে চার সপ্তাহের স্থলে ১১ সপ্তাহ কেটে গেলেও জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতর পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ফলে সম্প্রতি ফের দিনারপুর এলাকায় পাহাড় কাটা বেড়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশনার পরও প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদরা।
মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আদালত পাহাড় কাটা বন্ধে নির্দেশনা দিয়েছে, প্রশাসন সেটা প্রয়োগ করা উচিত। তাদেরকে আদালত বললেই আইন প্রয়োগ করবে আর না হয় নীরব বসে থাকবে সেটা হয় না। আদালতের নির্দেশনা ছাড়াই ডিসি ও ইউএনও-কে পাহাড় কাটা বন্ধের জন্য আইন প্রয়োগ করতে হবে। ১১ সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ না করার বিষয়টি দুঃখজনক। মে মাসের প্রথম দিকে এ নিয়ে একটি শুনানি হবে। তখন বিষয়টি আদালতের নজরে আনার চেষ্টা করবো।’
এ নিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, ‘যেভাবে পাহাড় ও টিলা কাটা হয় এবং এতে করে সার্বিক পরিবেশ প্রতিবেশের ওপর যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে- তা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে না। অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় যে, উচ্চ আদালত সময় বেধে নির্দেশনা দিয়েছেন পাহাড়-টিলা রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য, কিন্তু নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হলেও কার্যকর কোনও পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। রাষ্ট্রের সম্পদ রক্ষা করার জন্য যে কার্যকর ভূমিকা থাকার দরকার, আইন প্রয়োগ দরকার সেটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রহণ করছেন না ফলে পাহাড় ও টিলা কাটা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
এ বিষয়ে জানতে নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান শাহরীয়ারের মোবাইল নম্বরে টানা তিন দিন যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এ প্রসঙ্গে হবিগঞ্জ পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আখতারুজ্জামান টুকু বলেন, ‘আমি ডিসি অফিসে মিটিংয়ে আছি, এক ঘণ্টা পরে কথা বলবো।’ পরে যোগাযোগ করা হলে তিনি আর রিসিভ করেননি।
হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান বলেন, ‘আদালতের আদেশের বিষয়টি আমি জানি না। তবে পাহাড় কাটা হলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’