কনকনে শীতে জমজমাট ঢাকা লিট ফেস্ট

সারা দেশেই বইছে শৈত্যপ্রবাহ। রাজধানীতেও কনকনে শীত, এমন আবহাওয়াতেও শিল্প ও সাহিত্যপ্রেমীদের পদচারণায় মুখর ঢাকা লিট ফেস্টের তৃতীয় দিন। শনিবার (৭ জানুয়ারি) আগের দুই দিনের ভিড়কে ছাপিয়ে গেছে লিট ফেস্ট প্রাঙ্গণ।

কুয়াশায় ঢাকা সকালে গুরুদোয়ারার আধ্যাত্মিক সুরের মাধ্যমে শুরু হয় তৃতীয় দিনের আনুষ্ঠানিকতা। এরপর সকাল ১০টায় আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে কোক স্টুডিও বাংলার নেপথ্যের গল্প শোনান সংগীতশিল্পী বুনো, আবির রাজবিন এবং চিত্রনাট্যকার গাওসুল আলম শাওন। একই সময় বাঙালির চিন্তার ইতিহাস নিয়ে কথা বলেন অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান ও তপধীর ভট্টাচার্য। 

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

একই সময়ে চলে ‘আইরা এবং তার মায়ের অভিযান’ নিয়ে গল্প বলার আসর। ‘আইরা আর মায়ের অভিযান’ সিরিজের বই প্রকাশ করে দুই বাংলার স্বনামধন্য অভিনেত্রী ও উন্নয়নকর্মী রাফিয়াত রশিদ মিথিলা এরমধ্যে বেশ প্রশংসিত হয়েছেন। তিনি ও তার কন্যা আইরা তাহরিম খান ছিলেন এই গল্প বলার আসরে। তারা গল্প পড়ে শোনান শিশু ও বাবা-মায়েদের। 

গল্প শোনাচ্ছেন মিথিলা ও তার কন্যা আইরা

এছাড়া এদিন শিশুদের জন্য ছিল ‘লাল পরী, নীল পরী’ শীর্ষক পাপেট শো। সকাল সোয়া ১১টায় বিশ্ব নিয়ে আলোচনা করেন ভারতীয় সাহিত্য সমালোচক অমিতাভ ঘোষ, নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক আবদুলরাজাক গুরনাহ ও পংকজ মিশ্র। একই সময়ে উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজ নিয়ে আলাপ করেন কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, শাহীন আখতার ও মোহিত কামাল। এরপর দুপুর সাড়ে ১২টায় থাকছে বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত অঞ্জলি শ্রীর আলোচনা। বইয়ের বাজার নিয়ে একই সময়ে আলাপ করেন খান মাহবুব, দীপঙ্কর দাস। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের সদস্যদের একটি সেশন ছিল এদিন। তাছাড়া বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের আয়োজনে পারফরম্যান্স এবং বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান ছিল দুপুর পৌনে ২টায়।

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

একই সময়ে ব্রিটিশ অভিনেত্রী টিল্ডা সুইনটনের সঙ্গে আলাপে মজেন ঢাকা লিট ফেস্টের পরিচালক আহসান আকবার। এরপর ভ্যাকসিন নিয়ে আলাপ করেন অ্যাস্ট্রাজেনেকার সহ-উদ্ভাবক সারাহ গিলবার্ট, তার সঙ্গে আলাপে ছিলেন ঢাকা লিট ফেস্টের পরিচালক ও প্রযোজক সাদাফ সায্। বিকালে উদ্ভাবনী আলাপে ছিলেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ ও স্থপতি মেরিনা তাবাসসসুম। একই সময়ে ধরা বাঁধার বাইরে যাওয়ার গল্প শোনান অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন, সঙ্গে ছিলেন অভিনেত্রী বন্যা মির্জা।

ছবি: নাসিরুল ইসলাম

এছাড়া কাল ছিল চলচ্চিত্র রিকশাগার্ল এর প্রদর্শনী, এ নিয়ে আলাপ করেন নির্মাতা অমিতাভ রেজা। মহাবিশ্ব নিয়ে আলাপ করেন অধ্যাপক ড মুহম্মদ জাফর ইকবাল। দিনশেষে বাউল শফি মণ্ডলের সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় তৃতীয় দিনের আয়োজন।

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

পাঁচ বছরের শিশু তাইয়্যেবাকে নিয়ে লিট ফেস্টে এসেছেন তার মা জেনিফার। তিনি বলেন, ‘লিট ফেস্ট বরাবরের মতোই ভিন্ন রকমের আনন্দ দেয়। এজন্য বেশি শীত পড়লো কি কম শীত পড়লো সেটা আমার কাছে ম্যাটার করে না। আজ সারাদিনে সূর্য ওঠেনি। শীতের মাঝে বাচ্চাকে নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলেও দারুণ মজা করেছে তারা। প্রথম দিন ক্লে স্টেশন-এ মাটি দিয়ে পিঠা বানিয়েছে। আজ ঠান্ডা বেশি, তাই মাটি-পানি কিছুই ধরতে দেইনি। পরে আবার দেখা যাবে আনন্দ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সবমিলিয়ে লিট ফেস্টের এমন ব্যতিক্রম আয়োজন চমৎকার লাগছে।’

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

লিট ফেস্টে ঘুরে ঘুরে স্টল গুলোতে গল্প ও কবিতার বই খুঁজছিল ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী শাহরিয়ার রাব্বি। বই খোঁজা নিয়ে এতোটাই মগ্ন ছিলেন যে আশেপাশের কোনও দিকেই মন ছিল না। তার বাবা একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলে বই পাগল। সে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে সবসময় বই পড়তে ভালোবাসে। যদিও এই যুগে সব ছেলেমেয়েরা মোবাইল বা ল্যাপটপে বেশি আগ্রহী কিন্তু সে একেবারেই অন্যরকম। প্রথম দিন আমার ব্যস্ততার জন্য লিট ফেস্টে আসতে পারেনি। আজ সে ১৭টা বই সংগ্রহ করেছে। গতকালও তার সংগ্রহ ছিল ছয়টা বই। সে আরও বই কিনবে, তাই ঘোরাফেরা করছি।’

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

ব্র্যাকের স্টলে মেয়েসহ বই দেখছিলেন তানজিম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়েটা অনেকটা ঘরকুনো। তার কোথাও যেতে ভালোই লাগে না। বৃহস্পতিবারে প্রথম দিনের জোর করে এখানে নিয়ে এসেছি। তার এসে এত ভালো লেগেছে যে, গত দুদিন সে আমাকে জোর করে নিয়ে এসেছে। এখানে সবচেয়ে ভালো লেগেছে টিকিট সিস্টেমটা। টিকেট না থাকলে হযবরল অবস্থা হতো। এখানে অনেকটা ক্লাস মেনটেইন করা হয়েছে। যা স্বাধীনভাবে উপভোগ করেছে। লিট ফেস্টে প্রথমবার এসে দারুন উপভোগ করছি। দিস ইস রিয়েলি আনকমন অ্যান্ড এনজয়েবল প্লেস, আই এনজয় এ লট।’

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

লিট ফেস্টে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের। মেহেরিন নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘লিট ফেস্টে সবচেয়ে মজা হয়েছে কনসার্টে। দেশি-বিদেশি নানান গানে সবাই নেচেছে ইচ্ছে মতো। মনে হচ্ছিল কোনও অন্য এক জগতে হারিয়ে গিয়েছি। বন্ধুরা সবাই মিলে এসেছি, সন্ধ্যা থেকেই কনসার্ট হচ্ছে। বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি গানে সবাই আনন্দ করছে। এই প্রথম আমার লিট ফেস্টে আসা। বাংলা একাডেমির ভেতরে এমন একটা আয়োজন নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এমন আয়োজন আমাকে মুগ্ধ করেছে।’

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

ঢাকা লিট ফেস্টের টাইটেল স্পন্সর হিসেবে থাকছে বাংলা ট্রিবিউন ও ঢাকা ট্রিবিউন। সেই সঙ্গে প্লাটিনাম স্পন্সর হিসেবে আছে দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড এবং স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হিসেবে থাকছে ব্রিটিশ কাউন্সিল। অনলাইন রেজিস্ট্রেশন ও সরাসরি টিকিটের লোকেশন জানতে লগইন করতে হবে www.dhakalitfest.com -এ। এবারের আয়োজনে প্রবেশের জন্য প্রয়োজন হবে টিকিটের। ২০০ ও ৫০০ টাকায় টিকিট পাওয়া যাচ্ছে। অনলাইনে এবং সশরীরে টিকিট কেনার সুযোগ থাকছে। এছাড়া বাংলা একাডেমির মূল প্রবেশমুখে থাকছে স্পট রেজিস্ট্রেশনের সুবিধা। ১২ বছরের কম বয়সী ও শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিরা বিনামূল্যে প্রবেশ করতে পারবেন। অনলাইন পেমেন্টের মাধ্যমে টিকিট কেনার ব্যবস্থা রয়েছে।

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

পাশাপাশি কয়েকটি নির্দিষ্ট জায়গায় পাওয়া যাবে এগুলো। যেসব স্থানে টিকিট পাওয়া যাবে– ঢাকা লিট ফেস্ট অফিস (নিকেতন, ঢাকা), মীনা সুইটস (বনানী এক্সপেরিয়েন্স জোন এবং পান্থপথ শাখা), মীনা বাজার (ধানমন্ডি ২৭, উত্তরা আউটলেট, ইসিবি চত্বর আউটলেট, শান্তিনগর আউটলেট, বনশ্রী ও মগবাজার আউটলেট), বাংলার মিষ্টি (বনানী ও গুলশান আউটলেট), আড়ং (মিরপুর, গুলশান ও উত্তরা আউটলেট) এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। www.dhakalitfest.com লিংকে ঢুকে রেজিস্ট্রেশন করা যাবে। এজন্য উল্লেখ করতে হবে দর্শনার্থীর নাম, বয়স, লিঙ্গ, পেশা, মোবাইল নম্বর এবং ইমেইল ঠিকানা। সব তথ্য সঠিকভাবে দেওয়ার পর টিকিট ক্যাটাগরি নির্বাচন করতে হবে। ঢাকা লিট ফেস্টের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে জানানো হয়েছে, টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে দৈনিক জনপ্রতি ৫০০ টাকা। একসঙ্গে চারদিনের টিকিটে ছাড় মিলবে ৫০০ টাকা, সেক্ষেত্রে একেক জন দর্শনার্থী ১৫০০ টাকায় চারদিনের টিকিট পেয়ে যাবেন।

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

এদিকে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে সুখবর। তারা প্রতিজন ২০০ টাকায় টিকিট কিনতে পারবেন। শিক্ষার্থীদের বেলায় একসঙ্গে চার দিনের টিকিট কিনলে লাগবে ৫০০ টাকা, অর্থাৎ তাদের জন্য থাকছে ৩০০ টাকা ছাড়। এছাড়া আয়োজনের পৃষ্ঠপোষক (স্পন্সরশিপ) হিসেবে যুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকছে। কেউ ৩ হাজার টাকা মূল্যের টিকিট কিনলে ঢাকা লিট ফেস্টের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিবেচিত হবেন। এক্ষেত্রে একসঙ্গে চার দিনের টিকিট পাওয়া যাবে ১০ হাজার টাকায়। পৃষ্ঠপোষক ক্যাটাগরির আওতায় পাওয়া যাবে ফ্রি পার্কিং সুবিধা, ভিআইপি আইডি কার্ডসহ ঢাকা লিট ফেস্টের বিশেষ লাউঞ্জে প্রবেশের সুযোগ, যেখানে থাকছে লাঞ্চের ব্যবস্থা। কিন্তু লিট ফেস্টের সেশনগুলোতে তারা বিশেষ কোনও সুবিধা পাবেন না। সেখানে সব দর্শনার্থীর সমান অধিকার থাকবে।