পর্দা নামলো ঢাকা লিট ফেস্টের

সাহিত্যিক, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক ও চিন্তাবিদদের দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম বৃহৎ মিলনমেলা ঢাকা লিট ফেস্টের দশম আসর শেষ হলো। এই চারদিন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ছিল সাহিত্যপ্রেমীদের অন্যতম এক গন্তব্য। তাদের পদচারণায় মুখর ছিল পুরো প্রাঙ্গণ। এই চারদিনে ১৭৫টি সেশনে অংশ নেন শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার পাঁচ মহাদেশের ৫ শতাধিক বক্তা। রবিবার (৮ জানুয়ারি) বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে শেষ হয় ঢাকা লিট ফেস্টের দশম আসর।

সমাপনী অনুষ্ঠানের শুরুকেই ঢাকা লিট ফেস্টের আয়োজক প্রতিষ্ঠান যাত্রীকের প্রযোজনায় নায়লা আজাদের পরিচালনায় নারী অধিকার, সমতা, সংগ্রামকে প্রাধান্য দিয়ে প্রদর্শিত হয়েছে নৃত্য। পরে শুরু হয় বক্তব্য পর্ব।

ছবি: নাসিরুল ইসলাম

সমাপনী অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক বুকারজয়ী ভারতীয় লেখক গীতাঞ্জলি শ্রী বলেন, ‘অসাধারণ পাঁচটি দিন (উৎসবের চার দিনসহ) কাটিয়েছি এখানে। এটি একটি চমৎকার আয়োজন। আয়োজকদের অতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ। এটি একটি সত্যিকার অর্থে পাঠক লেখকদের সমাবেশ। একজন ভারতীয় হিসেবে বলতে চাই, এখানে আমি নিজেকে ভিনদেশি মনে করিনি। আমাদের মধ্যে অনেক কিছু আছে। দুই দেশের সীমানা কখনও আমাদের আলাদা করতে পারে না।’

গীতাঞ্জলি শ্রী। ছবি: নাসিরুল ইসলাম

ফেস্টে অন্যতম আলোচক ছিলেন সোমালিয়ান সাহিত্যিক নুরুদ্দিন ফারাহ। বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী এই বিশ্বখ্যাত এই ঔপন্যাসিক বলেন, ‘আমি যখন কেপটাউনে ফিরে যাবো, আমার বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করবে এখানে কি হয়েছে, কারা এসেছেন। আমি বলবো, এই উৎসব অন্যান্য উৎসব থেকে একেবারেই ভিন্ন। আমি এখানে নেমে যা ধারণা করেছিলাম তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাকে যখন জিজ্ঞেস করবে, কী সংখ্যক মানুষ শুনতে এসেছিল, আমি বলবো ডোনাল্ড ট্রাম্পের এনিভার্সারি থেকেও বেশি মানুষ এসেছিল (মজার ছলে বলেন)। এখানকার খাবার চমৎকার। আয়োজকদের ব্যক্তিগত বাড়িতে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমি তাদের অতিথেয়তায় মুগ্ধ। তাদের ধন্যবাদ জানাই। এই আয়োজন থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি, আশা করি আপনারাও শিখেছেন।’

নুরুদ্দিন ফারাহ। ছবি: নাসিরুল ইসলাম

অনুষ্ঠানে টাইটেল স্পন্সর ঢাকা ট্রিবিউন ও বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষে ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান বলেন, মহামারির তিন বছর স্থগিত থাকার পর শুরু হয়, এই আয়োজন শেষ হয়ে যাচ্ছে। ঢাকা লিট ফেস্ট এই শহরের একটি অংশ হয়ে গেছে। তরুণ-তরুণীদের পদচারণায় মুখর এই প্রাঙ্গণ দেখে বোঝা যায় এই আয়োজনের সফলতা। আয়োজকরা চমৎকার একটি আয়োজন দিয়েছেন এই শহরে।’

জাফর সোবহান। ছবি: নাসিরুল ইসলাম

আয়োজনের প্লাটিনাম স্পন্সর সিটি ব্যাংকের সিইও মাসরুর আরেফীন বলেন, ‘আমি একজন সিরিয়াস ধরনের লেখক। আমি কাজী আনিস আহমেদকে নিয়ে খুব আশাবাদী। তিনি একজন ভালো লেখক। লেখা এবং লেখক নিয়ে তার লক্ষ্য স্পষ্ট। যখন বিদেশি লেখকরা আমাদের এখানে আসেন, তখন আমাদের লেখকদের সঙ্গে তাদের একটি আদান-প্রদান হয়। আগামীবার আমরা এই আয়োজনের বড় স্পন্সর হবো বলে আশা করি।’ 

মাশরুর আরেফীন। ছবি: নাসিরুল ইসলাম

এসময় তিনি ঢাকা লিট ফেস্ট কর্তৃপক্ষকে একটি ট্রান্সলেশন সেন্টার তৈরির আহ্বান করেন এবং তাতে সিটি ব্যাংকের অর্থায়নের নিশ্চয়তা দেন। 

ঢাকা লিট ফেস্টের পরিচালক ও প্রযোজক সাদাফ সায বলেন, ‘সবকিছু পাশে রেখে আমার বিশ্বাস ছিল উৎসবে। সবার অংশগ্রহণ ছাড়া এই আয়োজন সফল হতো না। আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাই।’ এসময় তিনি এই আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে ধন্যবাদ জানান। এসময় আয়োজনের অপর দুই পরিচালক আহসান আকবার ও ড. কাজী আনিস আহমেদও উপস্থিত ছিলেন।

সাদাফ সায। ছবি: নাসিরুল ইসলাম

এর আগে দিনভর নানা সেশনে পার হয়েছে শেষ দিন। সেই সঙ্গে এদিন ছিল ফিল্ম স্ক্রিনিং, আলোচনা, সংগীত পরিবেশন। দিন শেষে দর্শকদের আন্দোলিত করে কোক স্টুডিও বাংলার কনসার্ট।

রবিবার (৮ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ৯টায় কীর্তনের মাধ্যমে শুরু হয় শেষ দিনের আয়োজন। এরপর সকাল ১০টায় ভবিষ্যতের বিজ্ঞান, ইংরেজি বাংলা সাহিত্যের ধাঁধা নিয়ে হয়েছে আলোচনা। সকাল সোয়া ১১টায় নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক আবদুলরাজাক গুনরাহ আলাপ করেছেন তারই বইয়ের সম্পাদক অ্যালেক্সান্ডার প্রিঙ্গেলের সঙ্গে। বিশ্বায়নের কালে ভবিষ্যতের কবিতা কেমন হবে তা নিয়ে আলোচনা করেছেন গৌতম গুহ রায়, সঙ্গে ছিলেন আশরাফ জুয়েল ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মোহাম্মদ নুরুল হুদা। 

সমাপনী 05

দুপুর সাড়ে ১২টায় পুরুষত্ব বনাম পুরুষতন্ত্র বিষয়ে আলাপে মজে ছিলেন অভিনয় শিল্পী ইরেশ জাকের, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহিন সুলতান, ব্র্যাক জেন্ডার, জাস্টিজ ও ডাইভারসিটি প্রোগ্রাম পরিচালক নবনীতা চৌধুরী, অভিনয় শিল্পী আজমেরী হক বাঁধন, তাকবীর হুদা, আইনজীবী তাসাফফি হোসেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন অভিনেত্রী বন্যা মির্জা। 

‘ভুল তথ্যের যুগে স্বাস্থ্য’ নিয়ে আলোচনা করেছেন রেসা লুইস ও বিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা। ‘কোন বই পড়তে হবে!–এটি নির্ধারণ করবে কে?’ এ নিয়েও হয়েছে আলোচনা। খাবার বিষয়ে আলোচনা করেছেন খাবার বিষয়ক বই লেখক ও শেফ ভ্যালেন্টাইন ওয়ারনার, তার সঙ্গে ছিলেন ঢাকা লিট ফেস্টের পরিচালক আহসান আকবার। দিনশেষে চমক হিসেবে ছিল কোক স্টুডিও বাংলার কনসার্ট। এতে অংশ নেন অনিমেষ রায়, পান্থ কানাই, ঋতুরাজ, নন্দিতা, সুনিধি নায়েক, রুবায়াত রেহমান ও বগা তালেব।