সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা (শেষ পর্ব)

সংস্কৃত ও পালি শিক্ষার আধুনিকায়ন জরুরি

সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড

দেশে সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা পড়ানো হয় ২২৭টি কলেজে। কিন্তু এই শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে ৪০ বছর ধরে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সংস্কৃত ও পালি শিক্ষকরা নামমাত্র বেতনে কাজ করছেন। এ কারণে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদেরকে। তবুও ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষা ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছেন তারা। বিশেষজ্ঞদের অভিমত,বিশেষায়িত এই শিক্ষার আধুনিকায়ন জরুরি।

বিভিন্ন সময় সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড থেকে সরকারের কাছে এই শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। অথচ এই শিক্ষাকে মূলধারায় নিতে একমত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ১৯৯৬ সালে সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা আধুনিকায়নের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশও করেছিল ইউজিসি। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি।

সরেজমিন পরিদর্শন ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত চার দশকে সংস্কৃত ও পালি শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে সামান্য কিছু টাকা। ২২৭টি কলেজের ৬১৪ জন শিক্ষকের প্রত্যেককে সরকার থেকে মাসে বেতন দেওয়া হয় ১৭৯ টাকা ৪০ পয়সা। আর সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড চলে শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন ফি, ফরম পূরণ বাবদ নেওয়া অর্থ ও পরীক্ষা সংক্রান্ত আয় দিয়ে। এ কারণে শিক্ষকদের বেতন যেমন কম, তেমনই এই শিক্ষা বোর্ডেরও দুরবস্থা।

সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর বাসাবো বৌদ্ধ মন্দিরের ভেতরে মন্দিরের একটি ভবনের দুটি রুম নিয়ে এর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। শুধু রক্ষণাবেক্ষণের খরচ দিয়ে বিনা ভাড়ায় চলছে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটি। পদাধিকারবলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান। শিক্ষা বোর্ডের অবৈতনিক সচিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী। এছাড়া একজন উপ-সচিব, একজন হিসাবরক্ষকসহ এই বোর্ডের মোট জনবল ১০।

সারাদেশের মোট ২২৭টি কলেজে অধ্যক্ষ ও অধ্যাপক রয়েছেন ৬১৪ জন। এছাড়া ২২৭ জন কর্মচারীসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন মোট ৮৪১ জন। প্রতি বছর পরীক্ষায় অংশ নেন ২০ হাজারের মতো শিক্ষার্থী। এসএসসি পাসের পর তিন বছরের ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হন তারা। কাব্যতীর্থ, ব্যাকরণতীর্থ, আয়ুর্বেদতীর্থ, পুরাণ, জ্যোতিঃশাস্ত্র, স্মৃতি, বেদ ও বেদান্ত বিষয়ে পড়ানো হয় তাদের।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৭ সালের আগে দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো জাতীয় বেতন কাঠামোর আওতায় শিক্ষকরা মাসে বেতন পেতেন ১৪৯ টাকা ৫০ পয়সা। আর কর্মচারীরা বেতন পেতেন মাসে ৬০ টাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘১৯৭৭ সালে সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক কারণে এই বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।’

একই কথা উল্লেখ করলেন সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ডের উপ-সচিব অসীম চৌধুরী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১৯৭৭ সালের জাতীয় বেতন কাঠামোতেই রাখা হয়নি সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা কলেজগুলোকে। এরপর চলতে থাকে অবহেলা। সবশেষ ২০১৫ সালে জাতীয় বেতন কাঠামো নির্ধারণের আগে এসব শিক্ষকের বেতন বাড়িয়ে ১৭৯ টাকা ৪০ পয়সা ও কর্মচারীদের বেতন ৭৮ টাকা করা হয়। প্রাচীন শিক্ষার ঐতিহ্য ধরে রাখা ও সামান্য ক্ষেত্রে প্রয়োজন মেটানোর প্রতিষ্ঠান হিসেবেই ৪০ বছরের অবহেলা সঙ্গী করে এসব কলেজ টিকে আছে। আদর্শগত কারণ ও ঐতিহ্য ধরে রাখার তাগিদে শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠানগুলো চালাচ্ছেন।’

সংশ্লিষ্ট দুটি সূত্র জানায়, ১৯৭৩ সালে সংস্কৃত ও পালি শিক্ষকদের জাতীয় বেতন কাঠামোর আওতায় আনেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকে ১৯৭৫ সালে সপরিবারে হত্যা পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় আসা সরকার সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক আদর্শের কারণে সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা কলেজকে বেতন কাঠামোর বাইরে ঠেলে দেয়। কিন্তু প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রতিষ্ঠানগুলো বাঁচিয়ে রেখেছেন নিবেদিত একদল মানুষ।

সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ডের সচিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী বলেন, ‘প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রাখতেই কোনোরকমে এই শিক্ষা ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা হয়েছে। আমরা বিভিন্ন সময় সরকারের কাছে শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছি। এই শিক্ষাকে মূলধারায় নিতে আমাদের প্রস্তাবের পক্ষে মত রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি)। ১৯৯৬ সালে সংস্কৃত ও পালি শিক্ষাকে আধুনিক করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছিল ইউজিসি। কিন্তু সেটি এখনও সেভাবেই পড়ে আছে।’

সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ডের দাবিকে যৌক্তিক মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তার মন্তব্য, ‘সরকারের উচিত দ্রুত এটি বাস্তবায়ন করা। খুব কমসংখ্যক কলেজ ও শিক্ষক তাদের, ফলে সরকারের কাছে এটি করা সহজ। ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষা ব্যবস্থায় এখনও অনেক শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে, এটি একটি বড় সাফল্য। ফলে মাদ্রাসা শিক্ষার মতো এই শিক্ষার আধুনিকায়ন জরুরি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মন্তব্য— সংস্কৃত কলেজগুলোর শিক্ষা অন্য কোনও শিক্ষার চেয়ে ছোট বা বড়, সেই বিচারে যাওয়া উচিত নয়। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোনও কারণেই বলার সুযোগ নেই এটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষা বা এটা তারাই দেখভাল করছেন। যে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তাতে জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নিরূপণ করা মোটেই কাম্য নয়।’

তিন বছরের কোর্স সংস্কৃত ও পালি শিক্ষাকে এইচএসসি সমমানের করার পরামর্শ দিয়েছেন ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। এছাড়া এই কোর্সকে পাঁচ বছরের বাড়িয়ে ডিগ্রি সনদের সমান করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। পাশাপাশি পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যক্রম আধুনিক করারও পরামর্শ দেন এই অধ্যাপক।

সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ডের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মাউশি পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। শিক্ষকদের জাতীয় বেতন স্কেলে অথবা নির্ধারিত বেতনের আওতায় আনার প্রস্তাবনা রয়েছে। পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যক্রম পরিমার্জনের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক করতে মাউশির গঠন করা কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী আমরা প্রস্তাব করেছি।’

জানা যায়, ১৯৯৬ সালে ইউজিসির সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল— সংস্কৃত ও পালিকে আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা, মাদ্রাসা শিক্ষার মতো সংস্কার;  ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে সংস্কৃত ও পালি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা, নবম ও দশম শ্রেণিতে সংস্কৃত ও পালি সাহিত্য বিষয়ে ১০০ নম্বরের একটি পত্র যোগ করা, ডিগ্রি স্তরে সংস্কৃত ও পালি সাহিত্যের পাশাপাশি ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম রাখা। এছাড়া ডিপ্লোমা কোর্সটির সংস্কার, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষার সনদের সঙ্গে সংস্কৃত ও পালি শিক্ষার সমতা এবং এই শিক্ষা বোর্ডকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বায়ত্তশাসিত বোর্ডে রূপান্তরের সুপারিশ করে ইউজিসি।