২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইনে আদেশ বা পত্র প্রকাশ করা তথ্য গোপন না করার নির্দেশ থাকার পরও এমন নির্দেশনা জারি করায় সরকারি কর্মকর্তা ও প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালকের কার্যালয় থেকে জারি করা পত্রে বলা হয়, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারি আদেশ, নোটিশ, পরিপত্র ইত্যাদি শেয়ার করার ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। ’ এই নির্দেশনা জারির পর প্রাথমিকের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আদেশ জারি করে মূলত তথ্য অধিকার আইন পরিপন্থী নির্দেশনা দিয়েছেন উপপরিচালক।
আইনের ৬ ধারার ১ উপধারায় বলা হয়, ‘প্রত্যেক কর্তৃপক্ষ উহার গৃহীত সিদ্ধান্ত কার্যক্রম, কিংবা সম্পাদিত বা প্রস্তাবিত কর্মকাণ্ডের সকল তথ্য নাগরিকের নিকট সহজলভ্য হয়, এরূপে সূচিবদ্ধ করিয়া প্রকাশ ও প্রচার করিবে। ’ আইনে ৬ ধারার ২ উপধারায় বলা হয়, উপ-ধারা (১) এর অধীন তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের ক্ষেত্রে কোনও কর্তৃপক্ষ কোনও তথ্য গোপন করিতে বা উহার সহজলভ্যতাকে সংকুচিত করিতে পারিবে না।’
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরে উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারি আদেশ, পরিপত্র, প্রজ্ঞাপন, চিঠি যদি জারি করা হয় তাহলে সেটি পাবলিক ডকুমেন্ট। পাবলিক ডকুমেন্ট যদি কেউ তথ্য জানার জন্য শেয়ার করে তাহলে সেটি অপরাধ হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে তথ্য শেয়ার করা বন্ধের আদেশ জারি করা তথ্য অধিকার আইনের পরিপন্থী। তবে যদি কেউ অসৎ উদ্দেশে নিয়ে সেটা করে তাহলে সেটি অন্যায়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে শেয়ার করলে বা কমেন্ট করলে তা বোঝা যাবে। কিন্তু যদি কেউ তথ্য শেয়ার করার জন্য শেয়ার করে আর অন্যরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কমেন্টে করে, তার দায় শেয়ারকারীর নয়। কেন জারি করা আদেশ শেয়ার করা বন্ধ করা হয়েছে তা আমার বোধগম্য নয়।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিভাগীয় উপ-পরিচালক ইফতেখার হোসেন ভুঁইয়া বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ ওই অর্থে না, সমালোচনার ঝড় তুলে বিভিন্ন কমেন্ট করা হয়। অভ্যন্তরীণ আদেশ তো হতেই পারে। এটাই বা আপনার কাছেই গেলো কীভাবে? সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা বন্ধ করার জন্য এটি করা হয়েছে। নেগেটিভভাবে উপস্থাপন করে সমালোচনার ঝড় তোলা না হয় সে কারণেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে প্রকাশ করার কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজনে কাল (সোমবার) নির্দেশনাটি সংশোধন করা হবে।’
এর আগে গত ৩ ডিসেম্বর প্রাথমিকের মাঠ পর্যায়ের একজন সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে শাস্তিমূলক আদেশ জারি করেন উপ-পরিচালক ইফতেখার হোসেন ভুঁইয়া। ওই আদেশে অভিযুক্ত সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে শান্তি হিসেবে সতর্ক করা হয়। ওই চিঠিতে শাক-সবজি থেকে শুরু করে আসবাবপত্র পর্যন্ত নেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। এ বিষয়টি তুলে ধরে গত ৮ ডিসেম্বর বাংলা ট্রিবিউনে শাক-সবজি থেকে নিত্যপণ্য সবই “উপহার’ নেন শিক্ষা অফিসার!’ শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়।
এই খবর প্রকাশের ১২ দিনের মাথায় রবিবার (২০ ডিসেম্বর) ঢাকা বিভাগীয় উপ-পরিচালক ইফতেখার হোসেন ভুঁইয়া রবিবার (২০ ডিসেম্বর) প্রাথমিকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে চিঠি জারি করেন। এই চিঠিতে বলা হয়, সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয় ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জারি করা বিভিন্ন পত্র যেমন আদেশ/নোটিশ/পরিপত্র কতিপয় কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করছেন। এতে অনেক কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষক হয়রানি বা হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন। প্রাথমিক শিক্ষার প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। বিষয়টি দুঃখজনক, অনভিপ্রেত ও শৃঙ্খলা পরিপন্থী।’
এতে আরও বলা হয়, ‘এমতাবস্থায় বিভিন্ন জেলার আওতাধীন উপজেলা/থানার কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জারিকৃত বিভিন্ন আদেশ, নোটিশ বা পরিপত্র কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ফেসবুকে প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করা হলো। যদি কোনও কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষক উক্ত কার্যক্রমে জড়িত থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের জনা অনুরোধ করা হলো।’
প্রসঙ্গত, অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ২০০৯ সালে তথ্য অধিকার আইন পাস করে সরকার। আইনের ২ ধারায় (চ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘তথ্য’ অর্থে কোনও কর্তৃপক্ষ গঠন, কাঠামো ও দাফতরিক কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত যে কোনও স্মারক, বই, নকশা, মানচিত্র, চুক্তি, তথ্য-উপাত্ত, লগবহি, আদেশ, বিজ্ঞপ্তি, দলিল, নমুনা, পত্র, প্রতিবেদন, হিসাব বিবরণী, আলোকচিত্র, অডিও, ভিডিও, অংকিতচিত্র, ফিল্ম, ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়ায় প্রস্তুতকৃত যে কোন ইনস্ট্রুমেন্টস, যান্ত্রিকভাবে পাঠযোগ্য দলিলাদি এবং ভৌতিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য নির্বিশেষে অন্য কোনও তথ্যাবহ বস্তু উহাদের প্রতিলিপিও উহার অন্তর্ভুক্ত হইবে।’