ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্ট বাংলাদেশ-এ (ইউল্যাব) ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ’ যাত্রা শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির স্থায়ী ক্যাম্পাসে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের নবীন বরণ উপলক্ষে ‘প্রথম আগমনীর গান’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বিভাগের উদ্বোধন ঘোষণা করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
এসময় ঢাকা ও কলকাতার নবীন-প্রবীণ লেখক, কবি ও বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে জ্ঞানচর্চার উদযাপন করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ দায়িত্বশীলরা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান ইউল্যাবের উপাচার্য অধ্যাপক ইমরান রহমান।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বিভাগের শুভ উদ্বোধন ঘোষণার পর সেলিনা হোসেন বলেন, ‘‘ইউল্যাবে আজ বাংলা ও সাহিত্য বিভাগ চালু হচ্ছে, এটা অনেক আনন্দের। কারণ, অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সাহিত্য বিভাগ’ নেই। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যে বড় জায়গাটা ধারণ করে, দিগন্ত বিস্তারি চিন্তা আমাদের মাঝে প্রসারিত করছে, সেজন্য আমরা ইউল্যাব কর্তৃপক্ষকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।’’
তিনি বলেন, ‘আমি যখন যেখানে যাই সবাইকে বলি, আমাদের সাহিত্য ৪৭ পরবর্তী সময় থেকে যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ভিন্ন স্রোতমাত্রায়, সে জায়গাকে ধারণ করে আমাদের সাহিত্যকে অনুবাদ করবেন। এটা ইংরেজিকে মর্যাদা দেওয়া নয়, আমাদের মাতৃভাষাকে মর্যাদায় তোলা।’
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘আমরা জ্ঞানকে হারিয়ে ফেলেছি। কারণ, এটা জ্ঞানের যুগ নয়, এটা অর্থের যুগ। এক সময় ধর্মের যুগ ছিল, একসময় বিজ্ঞানের যুগ ছিল, শিল্প-সাহিত্যের যুগ ছিলে, দর্শনের যুগ ছিল। আজকের পৃথিবী সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, আজকে বিত্ত-বৈভবের যুগ। আজকে বিত্ত হচ্ছে পৃথিবীতে, সারা পৃথিবীজুড়ে বিত্তের এই আগ্রাসন আগে কখনও হয়নি৷ আমরা সেই যুগে এসে পড়েছি। সবকিছুর মূল্যবোধ আছে, কবিতার মূল্যবোধ আছে, দর্শনের মূল্যবোধ আছে, শুধু টাকার কোনও মূল্যবোধ নেই।'
তরুণ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘যদি বাংলার চর্চা করি, বাংলাকে বড় জায়গাতে নিতে যে ত্যাগ স্বীকার প্রয়োজন তা করি, তাহলে বাংলা পড়েও তুমি সফল হবে। যেটা করবে ভালো করে করবে। কারণ, পৃথিবী ভালোর কাছে ঋণী।’
স্বাগত বক্তব্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের উপদেষ্টা অধ্যাপক শামীম রেজা বলেন, ‘আজ ইউল্যাব দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু করে আমরা গর্বিত। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও ৪৪টি নৃ-গোষ্ঠী ভাষা ও সাহিত্য আছে, নৃ-গোষ্ঠী এসব ভাষা সাহিত্য নিয়েও ১০০ নম্বরের কোর্স থাকছে আমাদের। এটাই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়— যেখানে নৃ-গোষ্ঠীদের ভাষা পড়ানো হবে।’
এসময় তিনি ইউল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা কাজী শাহেদ আহমেদের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, ‘কাজী শাহেদ আহমেদ প্রথম মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তি হিসেবে আজকের কাগজ পত্রিকা করেন। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার পরিবর্তন ও অন্য ধরনের একটা পত্রিকা আনলেন, মুক্ত চিন্তার একটা পত্রিকা।’
প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে শুভঙ্কর দে অপু বলেন, ‘বাংলাকে শুধু পড়লে হবে না, ভালোবেসে পড়তে হবে। কারণ, মানুষই একমাত্র প্রাণী— যাকে মানুষ হয়ে উঠতে হয়, তাই মাতৃভাষার শিক্ষা গ্রহণ করলেই আমরা মানুষ হয়ে উঠতে পারবো।’
ভারতের কলকাতার কবি ও চলচ্চিত্র পরিচালক চন্দ্রিল ভট্টাচার্য বলেছেন, সাধারণত আমরা যখন শিক্ষা লাভ করতে আসি, আমরা জীবনকে উদযাপন করতে, জ্ঞান লাভ করতে, ভাষা চর্চাকে এগিয়ে নিতে, আমরা শিক্ষা লাভ করতে আসি না, টাকা উদযাপন করতে আসি।’
কবি চন্দ্রিল ভট্টাচার্য উল্লেখ করেন, খুব ভালো করে সাহিত্য চর্চার জন্য স্বাধীনভাবে লেখালিখির জন্য, চমৎকার আর্থিক স্বাচ্ছন্দ থাকা দরকার এবং তার দরুণ মনে যে প্রশান্তি আসে, তাতে সাহিত্য চর্চা আরও প্রসন্ন হয়। সেক্ষেত্রে যাদের কাছে পুঁজি আছে, প্রতিপত্তি আছে— তারা যদি এগিয়ে আসে, তাহলে বিষয়টা সহজ হয়, যা ইউল্যাবের ক্ষেত্রে সম্ভব হয়েছে, তাই আমি ইউল্যাব কর্তৃপক্ষকে অভিনন্দন জানাই।’
সমাপনী বক্তব্যে ইউল্যাব বোর্ড অব ট্রাস্টিজের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সামসাদ মর্তূজা বলেন, ‘আমাদের ইংরেজি বিভাগ ও বাংলা বিভাগ একে অপরের সম্পর্ক হিসেবে কাজ করবে। বাংলা বিভাগ যে জ্ঞান চর্চা করবে, সেই জ্ঞান ইংরেজিতে অনূদিত হবে। আমাদের ছাত্ররা চাইলে মিডিয়া স্ট্যাডিজ পড়তে পারবে, ব্যবসা পড়তে পারবে, ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন পড়তে পারবে। এটার মাধ্যমে জ্ঞানের যে কোনও সীমাবদ্ধতা হয় না, আমরা সেটা উদযাপন করতে চাই।’
অধ্যাপক ড. সামসাদ মর্তূজা বলেন, ‘আমরা যেটা করতে চাই চিন্তাকে শেখানো। যদি চিন্তার জায়গা পরিষ্কার না হয়, লেখা সম্ভব না, প্রকাশ করা সম্ভব না। আমাদের মূল উদ্দেশ্য চিন্তার জায়গাটা পরিষ্কার করা, সেই উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলা বিভাগের যাত্রা শুরু।’
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন
আরও পড়ুন:
প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ইউল্যাবে পড়ানো হবে নৃ-গোষ্ঠীদের ভাষা ও সাহিত্য
আমরা শিক্ষা লাভ করতে আসি না, টাকা উদযাপন করতে আসি:চন্দ্রিল ভট্টাচার্য