শিশুদের জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা

দেশের মোট জনসংখ্যার (শূন্য থেকে ১৭ বয়সী) ৩৩ শতাংশ শিশু। কাজেই ডেমোগ্রাফিক ডিবিডেন্ডের সুযোগ নিতে শিশুদের জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। রবিবার (২১ মে) রাজধানীর ইউনিসেফ ভবনে শিশু পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এই সুপারিশ উঠে আসে।

শিক্ষায় থেকে ঝরে পড়া রোধ, শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিত করা, পথশিশুদের বিদ্যালয়ে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে বাজেট বাড়ানোর বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

মতবিনিময় অংশ নেন ইউনিসেফের চিফ অব কমিউনিকেশন জেনি গ্যামিং, কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ শেলডন ইয়েট, চিফ অব পলিসি, মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন স্ট্যানলি গোয়াভুয়েয়া এবং ইকোনমিক অ্যানালাইসিস স্পেশালিস্ট মো. আশিক ইকবাল।

বাংলাদেশের শিশু পরিস্থিতি তুলে ধরে বলা হয়, বাংলাদেশ এখন ডেমোগাফিক ডিবিডেন্ড (জনসংখ্যাগত সুযোগ) অর্জনের সময় অতিক্রম করছে। এই সুযোগ সীমিত সময়ের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। ২০৩৩ সালে মধ্যে এই সুযোগ থাকবে না। ২০২০ সালে ১৩ জন কাজের বয়সী ব্যক্তিকে (ওয়ার্জ এজ পারসন) একজন বয়স্ক ব্যক্তির দায়িত্ব বহন করতে হয়েছিল। যেখানে ২০৪০ সালে ৬ জন কাজের বয়সী ব্যক্তিকে ১ জন বয়স্ক ব্যক্তির দায়িত্ব বহন করতে হবে। কাজেই ভবিষ্যতে আজকের তুলনায় অনেক বেশি উৎপাদনশীল প্রাপ্তবয়স্ক তৈরি করতে হবে। আর তা করতে হলে আজকের শিশুদের জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

জনসংখ্যা ও গৃহায়ণ জনশুমারি
সর্বশেষ জনসংখ্যা ও গৃহায়ণ জনশুমারি অনুযায়ী, দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬৯ দশমিক ৮ মিলিয়ন। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যার (শূন্য থেকে ১৭ বয়সী) ৩৩ শতাংশ শিশু। শূন্য থেকে ১১ বছর বয়সী শিশু ৫৬ দশমিক ৯ মিলিয়ন। পাঁচ বছরের কম বয়সী শূন্য থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশু ১৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন। শূন্য থেকে ১১ মাস বয়সী শিশু ৩ দশমিক ৪ মিলিয়ন। স্কুল বয়সী ৬ দশমিক ১৭ বছরের শিশু ৩৭ দশমিক ৩৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন।

বাংলাদেশের শিশুদের পরিস্থিতি
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ২০১৬ সালের ইউএনএফপিএ এবং ২০১৫ সালের রিপোর্ট অন ভায়োলেন্স এগেইনস্ট ওম্যানের (ভিএডব্লিউ) তথ্য অনুযায়ী, এক থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের ওপর সহিংসতার হার ৮৯ শতাংশ। জনসংখ্যা ও গৃহায়ণ জনশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের পথশিশুদের ৭১ দশমিক ৮ শতাংশ পড়তে বা লিখতে পারে না। ২০২২ সালের জরিপ অনুযায়ী সহিংসতায় নির্যাতন বা হয়রানির শিকার হয়েছে ৮২ দশমিক ৯ শতাংশ শিশু। আর ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ পথশিশু পথচারীদের দ্বারা এবং কর্মস্থলে সহিংসতার শিকার হয়েছে।

পথশিশুদের সুযোগ-সুবিধা
তুলে ধরে মতবিনিময় সভায় আরও জানানো হয়, নির্ভরযোগ্য সাম্প্রতিক তথ্য না থাকলেও, বেশির ভাগ সময় পথশিশুরা রাস্তায় বাস করে বা রাস্তায় কাজ করে। আর রাস্তায় ঘুমায় ৩০ দশমিক ১ শতাংশ শিশু। মৌলিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়া জনসমক্ষে বা খোলা জায়গা যেমন: রাস্তা, স্টেশন, টার্মিনাল, মাঠ ও পার্কে ঘুমায় এসব শিশু।

শিক্ষা পরিস্থিতি
২০২১ সালের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী এনরোলমেন্ট ৯৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করেছে ৮৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ঝরে পড়ার হার ১৪ দশমিক ১৫ শতাংশ।

ব্যানবেইসের (শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো) ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, মাধ্যমিকে এনরোলমেন্ট ৭০ দশমিক দশমিক ২৫ শতাংশ। মাধ্যমিক বিদ্যালয় শেষ করতে পেরেছে ৬৪ দশমিক ২৪ শতাংশ। এ সময় ঝরে পড়েছে ৩৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ শিশু।

জন্মনিবন্ধনের তথ্যের বিষয়ে জানানো হয়, ২০১৯ সালের ইউনিসেফ, বিবিএস এবং মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে অনুযায়ী ৫৬ শতাংশ শিশু তাদের জন্মনিবন্ধন করেছে। আর ৪৪ শতাংশ শিশু তাদের জন্মনিবন্ধন করেনি (পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু)।

শিশুশ্রম
শিশুশ্রম নিয়ে মতবিনিময় সভায় জানানো হয়, প্রতিবছর ১১ দশমিক ১৩ শতাংশ শতাংশ ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশু শিশুশ্রমে যুক্ত হচ্ছে। ২০১৯ সালের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে অনুযায়ী, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছে ৮ শতাংশ শিশু।

এ ছাড়া ২০১৫ সালের জরিপ অনুযায়ী ১৮ বছর বয়সের আগে বাল্যবিবাহ হয়েছে ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ শিশুর। জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে ক্ষতিগ্রস্ত ১৬৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ নম্বরে।

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুসহ বসবাসকারী ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুরা আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় যুক্ত রয়েছে, যা ৪০ দশমিক ৪১ শতাংশ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬৫ দশমিক ২৫ শতাংশ, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৩৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

এ ছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে সমস্যা, নবজাতকের মৃত্যু, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে উন্নয়ন ঘটাতে হবে বলে জানান আলোচকরা।

জন্মনিবন্ধন সংক্রান্ত সমস্যা নিরসনও জরুরি মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১৯ সালের ইউনিসেফ, বিবিএস এবং মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে অনুযায়ী, ৫৬ শতাংশ শিশু তাদের জন্মনিবন্ধন করেছে। আর ৪৪ শতাংশ শিশু জন্মনিবন্ধন করেনি (পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু)। আলোচনায় এই তথ্যও উঠে আসে।

আলোচনায় উঠে আসা সমস্যাগুলো সমাধানে চলতি বাজেটে যেমন শিশুদের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি, তেমনি পরবর্তী বাজেটগুলোতেও শিশুদের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞরা।