এমন অনেক প্রশ্নই এখন অবান্তর, প্রশ্নাতীত। দেশের অন্যতম প্রধান সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টম্বর) চলে গেছেন না ফেরার দেশে। শেষ সময়ে এসে তিনি লিখতে শুরু করেন একটা নাটক। তিনি যার নাম দিয়েছেন ‘শেষ যোদ্ধা’। আর সেটাকে নির্দেশনা দেওয়ার কথা নাট্যজন ও ঢাকা থিয়েটারের সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফের। বিষয়টির ইঙ্গিত পাওয়া যায়, চলতি মাসের একেবারের প্রথমদিকে। যখন সৈয়দ হক চিকিৎসার জন্য লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। সেখানেই দেখা করেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। দুরারোগ্য ক্যানসারের চিকিৎসা আর সম্ভব নয়- এই হৃদয়ভাঙা খবর নিয়ে লন্ডন থেকে যখন কবি ফিরছেলেন, তখন বিমানবন্দরে তাকে বিদায় দিয়ে এক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে সে নাটকের কথা জানান নাসির উদ্দিন ইউসুফ।
সমাপ্ত অথবা অসমাপ্ত সেই পাণ্ডুলিপি এবং অন্যান্য প্রসঙ্গে এই নাট্যজন বাংলা ট্রিবিউনকে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বললেন অনেক কিছুই। বলতে বলতে স্মৃতিকাতর হয়েছেন, বলাই বাহুল্য।
‘‘এই তো সেদিন লন্ডনে আমি যখন হক ভাইকে (সৈয়দ শামসুল হক) দেখলাম, খুব মুগ্ধ হলাম। কারণ, তিনি তার লেখা তখনও থামাননি। আশ্চর্য এক মনোবল নিয়ে লিখেই চলেছেন। এটা ভাবা যায়! একজন রোগগ্রস্থ, শোকগ্রস্থ মানুষ লিখে চলেছেন অবিরত। রুগ্ন-ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে নিয়মিত লিখছেন। রোগকে অস্বীকার করছেন, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও নাটক লিখেছেন!
সে সময়ে শুধু নাটক নয়, তিনি নিয়মিত কবিতাও লিখেছেন। আমার জানা মতে, শতাধিক কবিতা তিনি অসুস্থ অবস্থায় লিখেছেন। আমাকে তখন জানালেন, তিনি একটি নাটক লিখছেন। নাম ‘শেষ যোদ্ধা’। বলেছেন, মোট ১৫টি খণ্ড হবে। এরমধ্যে তখন পাঁচ খণ্ড লিখে শেষ করেছেন। বললেন, তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি। তুমি দ্রুত ঢাকা এসো (তখন দুজনে লন্ডন) একসঙ্গে কাজ করব। আর সেটা হলো কই! তিনি ফেরার পর খুব বেশি সময় আর পাননি। আমার মনে হয়, তিনি শেষ করতে পারেননি লেখাটি।’’
স্মিত থেমে নাসির উদ্দিন ইউসুফ আবার শুরু করেন। বলেন, ‘তার লেখালেখির বিষয়ে একটি কথা ভাবলে ভালো লাগে। এটা শুধু তার জন্য নয়, প্রত্যেক সৃষ্টিশীল মানুষের ক্ষেত্রেই হয়তো ঘটে থাকে। একজন মানুষ মারা গেলে, তার স্বজনরা হয়তো কয়েক বছর তার জন্য শোকে মুহ্যমান হয়ে থাকে। কিন্তু একজন কবি মারা গেলে? সেটা হয়তো শতাব্দী পরও আলাদাভাবে মনে করা হয়। কারা করে? সেটা করে কবির ভক্তরা, পাঠকরা। হক ভাই আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তাকে নিয়ে আজ শুধু তার সজ্জন নয়, অজানা কোনও মানুষের চোখের কোণ ভারী হয়ে উঠছে ঠিকই। অনেক সংগঠন তাকে নিয়ে আয়োজন করবে। এটা তো কবির স্বার্থকতা। তিনি আমার যত কাছেরই হোন না কেন, তার বড় পরিচয়- তিনি আমার কবি!’
মনে পড়ে, ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রে যে বিলকিস চরিত্রকে দেখা গেছে, তা অনেকটাই আমি কাটাছেঁড়া করে করেছি। বিলকিসকে দেখানো হয়েছে যুদ্ধের আগে থেকে। আমি নিজে যেহেতু গেরিলা যোদ্ধা ছিলাম, তাই নিজের অভিজ্ঞতাও বসিয়েছি। কিন্তু তিনি কোনও বাধা দেননি! বরং খুশি হয়েছেন আমার চিত্রকল্পে।’’
সৈয়দ হকের খুব কাছের মানুষদের একজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। দীর্ঘ সময় খুব কাছ থেকে দেখেছেন সব্যসাচীকে। সে দৃষ্টি থেকেও বললেন এ নাট্যব্যক্তিত্ব।
‘‘৫০ দশকের পরবর্তী বা ষাটের দশকের পরেও আমাদের কবিরা ৩০ দশকের কল্লোল যুগ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। একটা বিষয়, আমার যেটা মনে হয়, হক ভাইয়ের মধ্যেও তার প্রভাব কিছুটা ছিল। এরপর তিনি কী করলেন? আমাদের লোক কাহিনি এমনভাবে তুলে আনলেন, আলাদা একটি কাঠামো দাঁড়িয়ে গেল তখন। নাটকে-গানে-সাহিত্যে-কবিতায় আলাদা ভাষারীতি তৈরি করেছেন তিনি। ‘খেলা রাম খেলে যা’র কথাই যদি বলি, সে সময়ে তিনি কতটা আধুনিক ছিলেন তা বোঝা যায়। অন্য একটি জগতের কথা তিনি নিয়ে এসেছেন। যা আমাদের মানসে থাকে। কিন্তু বলতে পারি না। আবার ‘নুরুলদিনের সারা জীবন’-এ তিনি দেখালেন রংপুরের এক মানুষকে। যিনি সবার জন্য লড়াই করেন, আবার যখন লোভ ভর করে তখন তিনি নিজেকে ভাবেন ঈশ্বর, রাজা। এই যে মানুষের দুটি দিক সাদা-কালো, তা দেখলেন অকপটে। তিনি চিত্রময় করে দেখালেন। আবার এটাকেই পশ্চিমা ধরনে উপস্থাপন করলেন! কী সুন্দর!
আমি আহবান জানাই সকল শাখার সংস্কৃতি কর্মীদের- আসুন আমদের কালের অন্যতম সেরা এই সাহিত্যিক-নাট্যকারের জীবন উদযাপন করি প্রাণ ভরে।
‘শেষ যোদ্ধা’র জীবন উদযাপন করে প্রতিদিন বাংলাদেশের বিভিন্ন মঞ্চে নিবেদন করি তারই রচিত গান, নাটক, কবিতা। কবিতায় বলি গানে বলি নাটকে বলি কিংবা বাংলা সাহিত্যে- শেষ যোদ্ধা তোমাকে অভিবাদন।’’
/এম/এমএম/