কানের ডায়েরি- তিন

সময় গেলে সাধন হবে না!

কানের ডায়েরি- তিনদক্ষিণ ফ্রান্সের শহর কানে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই উন্নত। যারা অন্য দেশ থেকে উড়ে আসেন, তাদের নামতে হয় নিস বিমানবন্দরে। সেখান থেকে ট্যাক্সি, বাস অথবা ট্রেনে চড়ে আসা যায় গার দো কানে (রেলস্টেশন)। বাস অথবা ট্রেনে খরচ তুলনামূলকভাবে কম। এ দুটি বাহনই এখানকার পর্যটকদের জন্য যোগাযোগের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক।

কান উৎসবের ৭০তম আসর শুরুর আগের দিন থেকে রোজ ট্রেনে চড়ে সেন্ট রাফায়েলে যাতায়াত করছি। আধঘণ্টা পরপরই বাস বা ট্রেন ছাড়ে এবং আসে এখানে। সবচেয়ে লক্ষণীয় ‍বিষয়, প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের শিডিউলে যে সময় উল্লেখ করা থাকে, তা এক মিনিটও এদিক-ওদিক হয় না। ১০টা ৪৪ মানে ১০টা ৪৪, ১১টা ১৫ মানে ১১টা ১৫।
শুধু ট্রেন না, পামবাসগুলোও ঘড়ি ধরে চলে। গার দো কান লাগোয়া বাসস্ট্যান্ডে ডিজিটালি সময় দেওয়া থাকে। ৮টা ১৫ মানে ৮টা ১৫, ৯টা ৪৫ মানে ৯টা ৪৫। যথাসময়ে বাস ছাড়ে এবং আসে। এই সময়ানুবর্তিতা অবাক করার মতো।
এখানকার সবকিছুই চলে ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী। প্রতিদিন সকালে প্রথমে রেডিওতে আড্ডা দেন প্রতিযোগিতা বিভাগের তারকারা। তারপর যান ফটোকলে। সেখান থেকে সংবাদ সম্মেলন। সবই সময় মেনে। উৎসবের প্রতিদিনকার সময়সূচিতে উল্লেখ করা সময়েই শুরু হয় সব ছবির প্রদর্শনী। এক মিনিটও নড়চড় হয় না।
তিন ৪ঢাকায় কোনও অনুষ্ঠানে এমনটা খুব একটা দেখিনি বললেই চলে। কান আর বাংলাদেশের সময়ের ব্যবধান চার ঘণ্টা। উৎসবের আয়োজনগুলো প্রতিদিন যখন শুরু হয়, ঢাকায় তখন দুপুরের খাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসে। ছবির প্রদর্শনী, সংবাদ সম্মেলন, লালগালিচা, বিভিন্ন দেশের প্যাভিলিয়ন, এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা শেষে যখন লিখতে বসি, ঢাকায় তখন সবার ঘুমানোর সময়, মধ্য রাত। তাই প্রতিদিন ঘড়ির দিকে বেশি সচেতন থাকতে হয়। কারণ, বাংলা ট্রিবিউনে খবরগুলো যথাসময়ে পাঠাতে হবে তো।
উৎসবে একটার পর একটা ইভেন্ট আছেই, তার ওপর প্রতিদিনই ঘটছে নানান ঘটনা। কোনও লেখা জমিয়ে রাখলে দেখা গেলো একে একে জমে যাচ্ছে পাহাড়! তাই যতটা সম্ভব একটা অনুষ্ঠান শেষ হলেই লিখে পাঠিয়ে দিচ্ছি ই-মেইলে। নয়তো আধেক লিখে কাজ এগিয়ে রাখছি।

তিনএ কারণে উৎসবের পঞ্চম দিন রবিবার (২১ মে) পড়েছিলাম আশঙ্কায়! সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় কান থেকে সেন্ট রাফায়েলে শেষ ট্রেন ছেড়ে চলে গেছে রাত ৮টা ০৯ মিনিটে। কিন্তু স্টেশনে এসেছি রাত সোয়া ৯টায়। ইনফরমেশন ডেস্কের ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, এদিন আর কোনও ট্রেন সেন্ট রাফায়েলে যাবে না। দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়লো কপালে।
কান থেকে সেন্ট রাফায়েলে যাওয়ার বাসও নেই। একমাত্র উপায় ট্যাক্সি। কিন্তু ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে দেখলাম ভাড়া আসবে ২০০ ইউরোর মতো। বাংলাদেশি মুদ্রায় ২০ হাজার টাকা! নিজের দেশের টাকার অঙ্ক মনে পড়ে যাওয়ায় ট্যাক্সির চিন্তা বাদ দিলাম। সঙ্গে আছেন ছবিয়াল আহামেদ ফরিদ। আপাতত কান লা-বক্কা পর্যন্ত যে ট্রেন যাবে সেটাতে ওঠার মনস্থির করলাম।
তিন ১ঘড়িতে তখন রাত ১০টা। কান লা-বক্কায় নেমে হাঁটতে থাকলাম সাগরপাড় ঘেঁষে ফুটপাতে। যেতে যেতে দেখলাম বিভিন্ন বয়সীরা সমুদ্রের গর্জন উপভোগ করছেন একান্তে। কেউ বিশাল আকারের বরশি নিয়ে এসেছেন মাছ ধরতে। এক কপোত-কপোতির ঝগড়াও চোখ এড়ালো না।
৪০ মিনিট হাঁটার পর পৌঁছলাম মান্দালিউ লা-ন্যাপোলে। এখানে পালম্যান নামে পাঁচতারা একটি হোটেল আছে ক্যাসিনোসহ। ওই হোটেলের সামনে জিরিয়ে নিতে বসলাম। তারও আধঘণ্টা পর ত্রাতা হয়ে গাড়ি নিয়ে এলেন প্রবাসী তরুণ মাহবুবুর রহমান। মাঝে তাকে ট্রেন মিস করার কথা জানিয়ে রেখেছিলাম। বাংলাদেশির প্রতি টান থেকে তিনি ছুটে এলেন।
তিন ৫গাড়িটির মালিক আলি। তিনিই চালকের আসনে। বক্সিং তার প্যাশন। এজন্য গাড়ির ড্রাইভিং সিটের সামনে ঝুলিয়ে রেখেছেন বক্সিংয়ের হ্যান্ডগ্লাভস আদলের শোপিস। মাহবুব ও আলি সম্পর্কে বন্ধু। এক বাংলাদেশিকে সহযোগিতা করতে বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বেরিয়ে এলেন আরেক বন্ধু, শুনেই মনটা ভরে গেলো।
প্রায় আধঘণ্টা অনেক গতিবেগে চলার পর সেন্ট রাফায়েলে এসে থামলো আলির গাড়ি। নেমে ভাবছিলাম, ট্রেন মিস হওয়ায় কি ধকলটাই না গেলো। লালন সাঁইজি তো আর এমনি এমনি বলে যাননি, ‘সময় গেলে সাধন হবে না!’
তিন ৩চলবে...
/জেএইচ/এমএম/