কে সে! দুঁদে পুলিশ কর্মকর্তা, সিআইডির গোয়েন্দা, নাকি কোনও প্রাইভেট ডিটেক্টিভ? ভারতবর্ষে তুমুল জনপ্রিয় চরিত্র ফেলুদা কি কাল্পনিক চরিত্র? নাকি বাস্তবেই এমন কেউ ছিলেন? তার আসল পরিচয় জানার কৌতূহল মিটতে যাচ্ছে। জগতখ্যাত নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের এ অমর সৃষ্টির রহস্যভেদে এগিয়ে এলেন তারই উত্তরসূরি সন্দীপ রায়। সত্যজিতের একমাত্র সন্তান। একগাল হেসে বললেন, ‘সত্যজিৎ নিজেই ফেলুদা নয় কি?’ সঙ্গে দিয়েছেন ব্যাখ্যাও। তার সেইসব কথামালা উঠে এলো বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে। ঢাকায় এসে গত ২৪ আগস্ট সকালজুড়ে কথা বলছিলেন সন্দীপ রায়। বাংলাদেশে তার আসার কারণ ওই একই— ফেলুদা। ঈদ উপলক্ষে চ্যানেল আইতে প্রচার হচ্ছে ‘ফেলুদা’র বাংলাদেশি সংস্করণ। চলুন পড়ি নির্মাতা সন্দীপ রায়ের সাক্ষাৎকার-
বাংলা ট্রিবিউন: বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের অমর চরিত্র ফেলু মিত্র ওরফে ফেলুদা। সে আসলে কে? আপনার বাবা সত্যজিৎ রায় কখনোই এ বিষয়ে মুখ খোলেননি। আপনাদের কাছে কি এ বিষয়ে কিছু বলেছিলেন?
সন্দীপ রায়: সত্যজিৎ রায় নিজেই কি ফেলুদা নয়? ভেবে দেখুন— গাম্ভীর্য, উচ্চতা, অসম্ভব বুদ্ধিমত্তা ও রসবোধ কি একই রকম নয়? আমার চোখে তো সবকিছুই একই। অবশ্যই বাবাই ছিলেন ফেলুদা। এ চরিত্রের মাধ্যমে তিনি আসলে নিজেই উঠে এসেছেন। ফেলুদার সততা, আন্তরিকতা, বুদ্ধি, জ্ঞান; সবই তো বাবার মতো দেখেছি। এমনকি ফেলুদার যা খেতে ভালো লাগতো বাবারও তা পছন্দ ছিল।
বাংলা ট্রিবিউন: সত্যজিৎ রায় আসলে কেমন মানুষ ছিলেন? আমরা বাইরে যেমনটা দেখি তেমনই কি, গম্ভীর?
সন্দীপ রায়: না, মোটেও তেমন নয়। গম্ভীরতা ছিল বটে। তবে তার সেন্স অব হিউমার ভীষণ ভালো দেখেছি। তিনি মানুষকে মুগ্ধ করতে পারতেন। তিনি ছিলেন খুবই রসিক। কাজের ফাঁকে হাসি-ঠাট্টা করতে ভালো লাগতো। একটা ব্যক্তিত্ব ছিল, এটা ঘটনা। ওটা বাইরের আবরণ। ভেতরের মানুষটা একেবারেই অন্যরকম। যারা একটু হলেও তার সঙ্গে মিশেছেন, তারা সেই অন্য মানুষটার খোঁজ পেয়েছেন। বাবা ছিলেন আর দশজন মানুষের মতোই। যদিও মোটেই সংসারী ছিলেন না। সংসারটা সামলাতেন আমার মা। তবে পরিবারের নানা বিষয়ের প্রতি বাবার নজর ছিল। তিনি ছিলেন খুবই ঘরোয়া মানুষ।
বাংলা ট্রিবিউন: বাবার কোন স্মৃতি বেশি মনে পড়ে?
সন্দীপ রায়: স্মৃতির সংখ্যা তো অনেক। কারণ তার সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছি। কাজেও বাবার সঙ্গে আমার বোঝাপড়া ভালো ছিল। একটা বিষয়, বাবা আমার সম্পাদনা বেশ পছন্দ করতেন। তবে আরও একটি বিষয় আছে, তিনি পরিচালক হিসেবে নির্মম ছিলেন! কোনও একটা ছবি হবে, এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। অনেক খাটাখাটি করে একটি দৃশ্য তৈরি করলেন। আমি তখন সম্পাদনার প্যানেলে। হুট করেই তিনি সেটা ফেলে দিতে বললেন। আমার তো আক্কেলগুড়ুম! পরে বাবার কাছে জানতে চাইলাম, তুমি এটা কেন করলে? তিনি বললেন— ‘অনেক ভেবে দেখলাম, এ দৃশ্যটা ছবিটাকে এগিয়ে নিচ্ছে না। ভালো হয়েছে দৃশ্যটি, কিন্তু এটা ছবিকে ঝুলিয়ে দিচ্ছে। তাই রাখার কোনও প্রয়োজন নেই।’
বাংলা ট্রিবিউন: তিনি কার কথা প্রাধান্য দিতেন, ছেলে নাকি সহকারী পরিচালক সন্দীপ রায়ের?
সন্দীপ রায়: এভাবে তুলনা করা মুশকিল। কিছু ঘটনা বলা যেতে পারে। ১৯৬১ সালে বাবা নতুনভাবে শুরু করলেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকা। প্রথমেই তিনি লিখলেন ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’, তারপর ‘শঙ্কু’। ১৯৬৫ সালে ‘ফেলুদা’ লেখার সময় লক্ষ্য করলেন, ছবির করার চেয়ে গল্প লিখেই চিঠি পাচ্ছেন বেশি। বিশেষ করে ছোটদের গল্প। তখন আমার বয়সও কম। ১২ বা ১৩ বছর হবে। একদিন আমিও বাবার কাছে আবদার করে বসি– তুমি তো শুধু বড়দের জন্যই ছবি করছো, ছোটদের জন্যও একটা ছবি করো না। কাজের চাপে পরিবারের জন্য খুব একটা সময় দিতে পারতেন না বাবা। এজন্য শুটিংয়ে আমাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। পড়াশোনার কথা ভেবে সাধারণত আমার ছুটির সময় দেখেই শুটিং রাখতেন তিনি।
বাংলা ট্রিবিউন: বাবার অনেক গুরুদায়িত্ব আপনার কাঁধে। নিজেই বাবার সৃষ্টি টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। কাজের বেলায় নিশ্চয়ই তাকে অনেক মিস করেন?
সন্দীপ রায়: (অনেকক্ষণ ভেবে) সত্যি বলতে কাজের ক্ষেত্রে বাবাকে তেমন মিস করি না! এর একটা বড় কারণ হতে পারে, পরিচালক হিসেবে যাত্রা শুরুর সময় বাবাকে এড়িয়ে কাজ করতে চাইতাম। তাকে কখনও পাশে রাখতাম না। পরিচালনার কথা বলছি। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কখনও বাবার শূন্যতা অনুভব হয় না আমার। তবে হ্যাঁ, একটা জায়গায় তাকে মিস করি। যখন সম্পাদনায় বসি। বাবার অনেক কাজের ভিডিও সম্পাদনা আমারই ছিল। তখন বাবা পাশে বসে থাকতেন। তিনি আমার সম্পাদনা পছন্দ করতেন। কিন্তু তিনি যে সিদ্ধান্ত দিতেন, দেখতাম সেটাই সঠিক। আমি বিস্মিত হতাম। এখন সম্পাদনার সময় মনে হয়, বাবা পাশে থাকলে অনেক ভালো সিদ্ধান্ত পেতাম।
মিউজিকের ক্ষেত্রেও তাকে মিস করি। আমি পরিচালনা শুরু করেছিলাম আশির দশকে, ১৯৮৩ সাল হবে। ছবিটির নাম ছিল ‘ফটিক চান’। তারপর বানালাম ‘গুপী বাগা ফিরে এলো’। তাতে যে মিউজিক আছে সেটা আমিই দিয়েছি। ’৯৩-৯৪ সাল থেকে মোটামুটি ছবিতে মিউজিক দেওয়া শুরু করেছি। মিউজিক শোনা বা তৈরির সময় তাকে (সত্যজিৎ) খুব মিস করি। এসব ক্ষেত্রে তার পরামর্শ খুব নিখুঁত ছিল। এজন্য কোনও সংশয় হতো না।
বাংলা ট্রিবিউন: সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টিকর্ম ধরে রাখার যে দায়িত্ব, ছেলে হিসেবে তা পালন করতে পেরেছেন। কখনও কি মনে হয়েছে, মৌলিক রচনা থেকে এটা আপনাকে সরিয়ে দিয়েছে?
সন্দীপ রায়: না, আমার কখনও তা মনে হয়নি। আমাদের অনেক কাজ একসঙ্গে করতে হচ্ছে। ছবি তৈরিতে মজা তো আছেই। এছাড়া আরও দুটি সমানতালে চালিয়ে যেতে হচ্ছে। একটা হচ্ছে সন্দেশ পত্রিকাকে দেখা। এটা আমাদের পারিবারিক পত্রিকা। আমার বড় দাদু উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ১৯১২ সালে চালু করেন এটা। এরপর আমার দাদু সুকুমার রায় এটা দেখেছেন। বেশ অনেক বছর বেরোয়নি। আমার বাবার দায়িত্বও ছিল তা দেখার। ১৯৬১ সালে আবার এটি বের হয়। এখনও চলছে। নিয়মিত নয়। বছরে ৫-৬টি সংখ্যা তো বের হচ্ছেই। সেটা আমারা অনেকে মিলেই দেখি। আমরা যারা নিজেদের ‘সন্দেশী’ বলি আরকি (হাসি)! মানে যারা ভীষণ আন্তরিক। সেখানেও কিন্তু আমাকে প্রচুর লিখতে হচ্ছে।
আর একটা কাজ আমরা করছি, সেটা হলো সোসাইটি তৈরি করা। বাবার কাজগুলো যেন আমরা ধরে রাখতে পারি। প্রথমত, ছবিগুলো উদ্ধার করা। এটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল। সেগুলো বিদেশে পাঠিয়ে রিস্টোর করতে হয়েছে। তাই এখন বলতে পারি, তার সব ছবি সংরক্ষণ করা হয়েছে ডিজিটালি। এবার আমরা তার কাগজপত্রগুলো পেতে চাই। তার প্রবন্ধ, লেখালেখি, খাতা, আঁকাআঁকি; এগুলো সংরক্ষণের কাজ করতে পারি।
প্রতি বছর বাবাকে ঘিরে স্মারক বক্তৃতা ও প্রদর্শনী হয়। এবার তো আমরা ফেলুদার ৫০ বছর উপলক্ষে করলাম। বিশাল বড় আয়োজন ছিল এটা। এগুলো সবই রায় সোসাইটির পক্ষ থেকে করা হয়েছে। বাংলাদেশে এটা নিয়ে আসতে চেষ্টা করছি। কারণ আমার মনে হয়, রায় পরিবার নিয়ে এই বাংলায়ও প্রচুর চর্চা হয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউন: অনেক ব্যস্ততায় সময় কাটে আপনার। তবুও বলি, বাংলাদেশের ছবি দেখার সুযোগ হয়?
সন্দীপ রায়: না, সুযোগ হয় না। কেমন করে হবে বলুন? আমাদের তো আদান-প্রদান নেই। তবে যৌথ প্রযোজনার ছবি দেখা হয়। যেমন গৌতমের (গৌতম ঘোষ) ছবি ‘মনের মানুষ’ আর ‘শঙ্খচিল’ দেখেছি। উৎসবে দু’একটি যায়, সেটা দেখা হয়। তবে বাবা বাংলাদেশের মানুষজনকে নিয়ে কাজ করেছেন। ববিতার কথা বলতে পারি। আমি নিজে ববিতার বোন চম্পাকে নিয়ে কাজ করেছি। কাজেই যোগাযোগ হয়। বাংলাদেশে খুব ভালো আর্টিস্ট আছে। একসময় ডেইলি নাটকগুলো খুবই ভালো লাগতো। এখন কী হয় তা অবশ্য জানি না।
বাংলা ট্রিবিউন: আচ্ছা, সত্যজিৎ রায়ের প্রিয় নায়িকা কে ছিলেন? ওই তালিকায় কি ‘অশনি সঙ্কেত’-এর অনঙ্গ বউ অর্থাৎ ববিতা ছিলেন?
সন্দীপ রায়: বাবার প্রিয় নায়িকার তালিকাটা বের করাটা একটু কঠিনই হবে। সেসময় দুদেশের শিল্পীদের মধ্যে কিন্তু ভালো যোগাযোগ হতো। বাবার সঙ্গেও অনেক শিল্পীদের আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। কিন্তু বাবার ছবিতে ববিতা অভিনয় করলেন। অন্যরাও প্রিয় শিল্পীর তালিকায় থাকতে পারেন! সেটা আমি বলতে পারব না।
আর একটা কথা, তখন বাংলাদেশের নাটকগুলো কলকাতায় খুব দেখা হতো। আর একটা পত্রিকা খুব যেত— চিত্রালী। অনেক শিল্পী কলকাতায় তখন নিয়মিতই যেতেন। রাজ্জাক সাহেব ওখানে গিয়েছিলেন আমাদের সভায়। বাবাও সেখানে ছিলেন। রাতে তিনি আমাদের বাসাতে খাওয়া-দাওয়া করেছিলেন। আমাদের জমিয়ে আড্ডা হলো। তখন আমি ছবি তুলতাম। আমার তোলা অনেক ছবি পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে।
রাজ্জাক সাহেব নেই, খবরটা ঢাকায় এসেই শুনলাম। খুবই খারাপ লাগলো তার চলে যাওয়ার কথা জেনে। তিনি এককথায় ছিমছাম লোক ছিলেন। এত বড়মাপের একজন অভিনেতা, কিন্তু অহংবোধ ছিল না বিন্দুমাত্র। অসম্ভব আড্ডাবাজ আর ভীষণ মিশুক ছিলেন। সত্যিকার অর্থেই তিনি নায়করাজ।
বাংলা ট্রিবিউন: পরমব্রত ফেলুদা হিসেবে কেমন করবে বলে আপনার মনে হয়?
সন্দীপ রায়: যতক্ষণ না দেখছি, ঠিক বলতে পারছি না। ট্রেলার দেখেছি। কিন্তু তাতে তাকে সেভাবে দেখানো হয়নি। তাই এখনই বলা মুশকিল। তোপসেকেই বেশি দেখানো হয়েছে। পরম তো আমাদের ছবিতে তোপসের ভূমিকায় কাজ করেছে। তখন সব্যসাচী ফেলুদা হয়েছেন। এখন পরমই ফেলুদা। বলা যায়, ওর পদোন্নতি হয়েছে (হাসি)। আমি খুব খুশি। নতুন প্রজন্মের হাত দিয়ে ফেলুদা দেখবো, তাই আমার উত্তেজনাও রয়েছে। কাজটা নিয়ে আমি ভীষণ আশাবাদী।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার মাধ্যমে ফেলুদাকে নিয়ে অনেক ভালো ভালো নির্মাণ পেয়েছি। যতদূর জানি কলকাতার অনেকে ‘ফেলুদা’ করতে চেয়েছিল। কিন্তু আপনি রাজি হননি। হয়তো এদিক দিয়ে বাংলাদেশের দর্শকরা ভাগ্যবান।
সন্দীপ রায়: এদেশের প্রতি আমাদের একটা টানও আছে। কিশোরগঞ্জ আমাদের আদি ভিটা। একটা টান তো থাকেই। এখানে রক্তের একটা টান আছে। কলকাতায় আমার কাছে বেশি লোক চেয়েছে, তাও কিন্ত নয়। আবার বেশি লোককে দিলে গোলমাল হয়ে যাবে। সেখানে আমি তো আছিই। এখন যেটা হয়েছে ‘ব্যোমকেশ’ অনেকে করছে। এটা আমার প্রিয় চরিত্র। কিন্তু দেখুন, বড় পর্দায় দু’জন ও ছোট পর্দায় দু’জন অভিনয় করছে। ব্যাপারটা কেমন বলুন তো!
বাংলা ট্রিবিউন: জটায়ুকে কি আমরা আবারও পাবো?
সন্দীপ রায়: এটা তো দারুণ মজার একটা চরিত্র। এর সঙ্গে মানায় এমন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না বলে কাজ শুরু করতে পারছি না। কলকাতায় পাইনি, দেখি বাংলাদেশে পাই কিনা!
বাংলা ট্রিবিউন: শেষ প্রশ্ন— সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, আবির চট্টোপাধ্যায় নাকি সব্যসাচী চক্রবর্তী, ফেলুদার ভূমিকায় এগিয়ে রাখবেন কাকে?
সন্দীপ রায়: অবশ্যই সব্যসাচীকে। তার সঙ্গে বাবার চরিত্রগুলো বেশ মানিয়ে যায়। যেমন উচ্চতা, গলার স্বর ও ভাবগাম্ভীর্য। ১৯৯২ সাল থেকে বেণুর (সব্যসাচীর ডাকনাম) সঙ্গে কাজ করছি। তার সঙ্গে আমার রসায়নটা খুব জমে। আর সে তো ফেলুদা হিসেবে সফলও।