যে হাসির উত্তর তখন অস্পষ্ট মনে হলেও ৬ এপ্রিল ‘স্বপ্নজাল’ মুক্তির পর ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠলো সেই মিষ্টি হাসির সেলিম-নীরবতার বিষয়টি। এবারও কি বিচ্ছেদ বেদনা? নাকি প্রেমময় বিজয়—নির্মাতা ঠিক কোন জালে জড়িয়েছেন দর্শকদের। যারা ছবিটি দেখে ফেলেছেন তারা তো জানেনই। তবে এখনও যারা ছবিটি দেখেননি সেই আকাঙ্ক্ষা বাঁচিয়ে রাখলাম তাদের জন্য।
সিনেমার গল্পে চলে আসা জরুরি। যদিও কোনও সিনেমার গল্প নিয়ে খুব বেশি আলোচনার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, গল্পটাই তো সিনেমার প্রধান হাতিয়ার। তাছাড়া আলোচনায় হাজির হয়ে গেলে সিনেমার পিপাসাটা কম হয়ে যায় বইকি। তাই অল্প কথায় গল্পটা বলা যেতে পারে, ‘স্বপ্নজাল’ নব্বই দশকের একটি কৈশোর সময়ের প্রেমের গল্প। চাঁদপুর শহরে নদীর তীরঘেঁষে বাস করা মুসলমান ও হিন্দু পরিবারের গল্প। পাশাপাশি বাড়িতে মুসলমান ঘরের ছেলে আর হিন্দু ঘরের মেয়ের মধ্যে প্রেম হয়। এই কৈশোর বেলার প্রেমে হাজির হয় অন্যরকম সংকট। নায়ক অপু, নায়িকা শুভ্রা। শুভ্রার বাবা নিখোঁজ হন। তারপর এক চিঠিকে কেন্দ্র করে শুভ্রাদের পরিবার পাড়ি জমায় কলকাতা। কলকাতায় শুভ্রা এবং চাঁদপুর শহরে অপু। তারা অপেক্ষা করে একে অপরের চিঠির। আহ্! প্রেমের কী তীব্র আবেদন তৈরি হয় তখন। এরই মাঝে শুভ্রার বাবার আরেকটি পরিণতি হাজির হয় অপুর সামনে। সিনেমায় নেয় নতুন মোড়। যা দেখার জন্য আপনাকে যেতে হবে সোজা প্রেক্ষাগৃহে। এর বেশি বলা প্রয়োজন আপাতত থাক।
স্বপ্নজালের সবচেয়ে দুর্দান্ত দিক কোনটি—এমন প্রশ্ন হাজির হতেই পারে। বলা যায়, ধর্মকে যেভাবে ডিল করেছেন পরিচালক তা এককথায় দুর্দান্ত। প্রেমের ফাঁকে ধর্মকে যেভাবে জায়গা দিয়েছেন, যেখানে ধর্মীয় পরিচয়ে সমাজব্যবস্থায় প্রেম ভালোবাসার স্থান নেই, সে বিষয়টি পরিচালক যেভাবে পর্দায় দেখালেন তা সত্যিই অসাধারণ। আরেকটি বিষয় হলো, এদেশের হিন্দুরা যেভাবে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে দেশান্তরিত হন কিংবা তাদের দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করে একশ্রেণির প্রভাবশালী মহল–সেই বিষয়টি ফ্রেমে তুলে এনেছেন পরিচালক। শুধু তাই নয়, পুরো সিনেমাজুড়ে দেখা যাবে পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমানের বাড়ি। তারা একে অপরের বিপদে পাশে থাকে। আসা যাওয়া হয়। কিন্তু যখন সেখানে প্রেম হাজির হয়, তখন ঠিকই সামনে আসে ধর্মীয় পরিচয়। এই অস্থির সময়ে পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সেলিম সাহসের সঙ্গে কাজটি করে দেখালেন। প্রমাণ করলেন, সূক্ষ্মভাবে সিনেমায় সব দেখানো সম্ভব, শুধু গল্পের ফ্রেমটা সাজাতে জানতে হয়।
‘স্বপ্নজাল’-এর গল্প যত না শক্তিশালী, তারচেয়ে শক্তিশালী তার ফ্রেম নির্বাচন এবং শিল্পীদের অভিনয়। নায়ক চরিত্রটির নাম হলো অপু। অভিনয়ে ইয়াশ রোহান। নায়িকা শুভ্রা। অভিনয়ে পরীমনি।
একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে জানা যায়, মিশা সওদাগরের অভিনয় করার কথা ছিল অপুর বাবার চরিত্রে, কিন্তু সময়ের অভাবে সে চরিত্রে তিনি কাজ করতে পারেননি। তিনি অভিনয় করেছেন শুভ্রার বাবা হিসেবে ছোট্ট একটি চরিত্রে। অথচ পুরো ছবিটি ছিল শুভ্রার বাবা মিশা সওদাগরকে কেন্দ্র করেই। এত অল্প সময়েও তিনি দেখিয়েছেন নিজের অভিনয় মুন্সিয়ানা। অন্যদিকে আয়নাল চরিত্রে ছিলেন ফজলুর রহমান বাবু। মঞ্চ-টিভি-চলচ্চিত্রের দুর্দান্ত অভিনেতা বাবু, একটি নেগেটিভ চরিত্রে আবার চিনিয়েছেন নিজের জাত। যদিও তার চরিত্রটিও কমিক সৃষ্টি করেছে সিনেমায়। প্রকৃতির শাস্তিতে নাকাল আয়নাল যখন বমি করে, যখন টয়লেটে দৌড়ায়–অসুস্থে কাবু হয়ে যায় তখন দর্শক তার ব্যথায় দুঃখিত হয় না বরং হাসে, তালি বাজায়। এটাই যেন চরিত্রের এক অন্যরকম খেলা। দিনশেষে যে খেলায় জিতে যান বাবু এবং পরিচালক সেলিম।
ছোট্ট চরিত্র অথচ কী দুর্দান্ত হতে পারে, তার প্রমাণ ইরেশ যাকের। এত অল্প সময় পর্দায় থেকেও দর্শক হৃদয়ে ঠিকই তিনি জায়গা পাবেন দীর্ঘ সময়।
স্বপ্নজালে আরও চরিত্র আছে। ইরফান সেলিম, ফারহানা মিঠু, শহিদুল আলম সাচ্চু, শিল্পী সরকার অপুসহ কলকাতার বেশ ক’জন পরিচিত শিল্পী। কারও অভিনয়ে এতটুকু ঘাটতি চোখে পড়েনি।
সিনেমাটির দৃশ্যায়ন হয় বাংলাদেশের চাঁদপুর ও ভারতের কলকাতা শহরে। কলকাতা শহর এবং নদীঘেঁষা চাঁদপুরের জীবন একটু হলেও ধরা দিয়েছে সেলুলয়েডে। স্বপ্নজাল খুব ধীরলয়ে এগুনো সিনেমা, এই ধীরলয় কিছুটা হলেও দর্শকের বিরক্তির কারণ হতো না, যদি গানের শক্তি থাকতো। ‘মনপুরা’য় অন্যতম শক্তি ছিল তার গান। তবে এই সিনেমায় পরিচালক যেন সেই শক্তি ব্যবহার করেননি। গান ছিল, তবে তিনটি। গানগুলো মন্দ নয়, তবে ‘মনপুরা’র মতো শক্তিশালী ছিল না।
এমনই প্রেম আর বিচ্ছেদের বিষাদের জালে আটকে ঘরে ফিরবেন দর্শক। হৃদয়ে থেকে যাবে অপু-শুভ্রার প্রেম আর বিষাদের গল্পটি।
গিয়াস উদ্দিন সেলিমের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মনপুরা’য় নায়ককে এক নির্জন চর কিংবা দ্বীপে নির্বাসনে রাখা হয়। এখানে শুভ্রার বাবাকে চর কিংবা জনমানবহীন দ্বীপে রাখা হয়। মনপুরা’তেও থৈ থৈ জলের খেলা দেখিয়েছেন পরিচালক, এবারও তাই। সমালোচনায় বলতে হয়– ‘মনপুরা’র সঙ্গে অনেক কিছুই মেলানো যায় ‘স্বপ্নজাল’-এর। তবে পরিচালক উতরে গেছেন নির্মাণ দক্ষতায়। পর্দায় চেনা-জানা গল্পটাকেও যে এভাবে বলা যায়, সেটা ‘স্বপ্নজাল’ না দেখলে বোঝা যাবে না। তবে সমালোচনার জায়গা থেকে পরিচালকের কাছে এই আশা করা যেতেই পারে, প্রতিবার একই ধাঁচের গল্প একই পরিচালকের কাছে আশা করেন না দর্শক। চান নতুন করে নতুনভাবে তাকে আবিষ্কার করতে।
স্বপ্নজাল
রেটিং: ৮/১০
পরিচালক: গিয়াস উদ্দিন সেলিম
প্রযোজনা: বাংলাদেশের বেঙ্গল ক্রিয়েশনস ও ভারতের বেঙ্গল বারতা
গল্প, চিত্রনাট্য ও সংলাপ: গিয়াস উদ্দিন সেলিম
অভিনয়ে: পরীমনি, ইয়াশ রোহান, মিশা সওদাগর, ফজলুর রহমান বাবু, শাহানা সুমী, শহিদুল আলম সাচ্চু, শিল্পী সরকার অপু, ইরফান সেলিম, ফারহানা মিঠু, ইরেশ যাকের, মুনিয়া, শাহেদ আলী, আহসানুল হক মিনু প্রমুখ।
সংগীত: রাশেদ শরীফ শোয়েব
চিত্রগ্রাহক: কামরুল হাসান খসরু
মুক্তি: ৬ এপ্রিল, ২০১৮
পরিবেশনা: আশীর্বাদ চলচ্চিত্র
লেখক: চলচ্চিত্র সমালোচক
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।