উঠেছে পঞ্চমীর চাঁদ

কান উৎসবে দেখা পাঁচমিশালি

দক্ষিণ ফ্রান্সের সাগরপাড়ের শহর কানের কথা কে না জানে! প্রতি বছর মে মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র অনুরাগীদের মিলনমেলায় পরিণত হয় কান উৎসব। তাই পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও প্রভাবশালী এই আয়োজনকে ঘিরে ফরাসি উপক‚ল কান হয়ে ওঠে মুখর। বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম বৃহৎ এই মিলনমেলায় বহুমাত্রিকতা আর বৈচিত্র্য চোখে পড়ার মতো। বাংলা ট্রিবিউন-এর চার বছর পেরিয়ে ‘উঠেছে পঞ্চমীর চাঁদ’ আয়োজনে তেমন পাঁচটি উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরা হলো-

জাদুকরি ভবন!

‘পালে দো ফেস্টিভ্যাল দ্য কোঁগ্র’ নামের একটি ভবন কান চলচ্চিত্র উৎসবের প্রাণকেন্দ্র। সেখানেই থাকে ১২ দিনের মূল আয়োজনগুলো। শুধু কান উৎসবের জন্যই নির্মাণ করা হয় এটি। ১৯৮৩ সালে আরও জাঁকালোভাবে সংস্কার করা হয় এই ভবন। ফরাসিরা আদর করে পালে দো ফেস্টিভ্যালকে ডাকে ‘দ্য বাংকার’। এই ভবনে ঢুকে না বেরিয়েই উৎসবের সব ভেন্যুতে যাওয়া যায়।

‘পালে দো ফেস্টিভ্যাল দ্য কোঁগ্র’তে ঢোকার প্রবেশপথের সামনে দাঁড়িয়ে দেখলে মনে হবে গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়ের ও সাল দুবুসি থিয়েটার বুঝি অন্য দুটি ভবন। আদতে কিন্তু মোটেও তা না। একটাই ভবন। এতে ঢুকে গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়ের, সাল দুবুসি থিয়েটার, সাল বুনুয়েল থিয়েটার, সাল সোসানতিয়েম থিয়েটার, সাল বাজিন থিয়েটারে যাওয়া যায়।

মেয়রের লাঞ্চ

উৎসবে অংশ নেওয়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদকর্মীদের জন্য মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন কান শহরের মেয়র ডেভিড লিসনার্ড। সাধারণত উৎসবের দশম দিন দুপুরে ঐতিহ্যবাহী লে শুকে’র কাছে পালে দো লা ক্যাস্তরে এটি হয়ে থাকে। সেদিকে যেতে যেতে সামনে পড়বে হোটেল দি ভিলসহ বেশ কিছু মনোরম স্থাপনা। দেখলেই মনে হবে আভিজাত্য কাকে বলে! পালে দো লা ক্যাস্তরে যেতে দুই মিনিট হাঁটার পর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে হয়। সিঁড়ি শেষে পাহাড়ি পথের মতো উঁচু পথ।

পালে দো লা ক্যাস্তরের ফটকের মুখে অতিথিদের জন্য প্লাস্টিকের গ্লাসে পরিবেশন করা হয় রেড ওয়াইন, অরেঞ্জ জুস ও পানি। যে যেটা খুশি নেন। অতিথিদের বরণ করে নিতে ফটকের ভেতরে দু’পাশে বাহারি সাজে দাঁড়িয়ে থাকেন বৃদ্ধারা। সেখানে পা রাখলেই কানে ভেসে আসবে ব্যান্ড পার্টির বাজানো বাদ্যযন্ত্রের সুর। ভেতরে ঢুকে বাঁ-দিকে আমন্ত্রণপত্র জমা দিলে হাতে আসে সাজানো অলিভ অয়েলের বোতল। টেবিলে রাখা খাবারের মধ্যে থাকে রেড ওয়াইন, পিঙ্ক ওয়াইন, পানি, বাগেল, বাটার। বুফেতে পরিবেশন করা হয় সামুদ্রিক মাছ, সবজি, ডিম ও মিষ্টান্ন। মেয়রের আমন্ত্রণ সাংবাদিকদের পাশাপাশি লাঞ্চ করেন কান চলচ্চিত্র উৎসবের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগের বিচারকরা।

পালে দো লা ক্যাস্তর থেকে দেখা যায় পুরো কান শহর। কানের আর কোথাও থেকে একসঙ্গে এতকিছু দেখার সুযোগ নেই। এখানে দাঁড়িয়ে শহরের প্রায় পুরোটাই দেখে ফেলা যায়! নীল আকাশের নিচে একপাশে সাগরের নীল জলরাশি। তীরে অনেক ইয়ট আর স্পিডবোট। সাগরের অন্য পাশে উঁচু উঁচু পাহাড়। তার মধ্যেই ঘর-বাড়ি, রিসোর্ট, হোটেল। এই নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়। আমন্ত্রণপত্রে মেয়র উল্লেখ করেন, ‘ফরাসি রেসিপি দিয়ে বানানো খাবারের মাধ্যমে আমাদের এই শহরের অন্যরকম একটি দিক সম্পর্কে জানার সুযোগ হবে আপনাদের। উৎসবে অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই এই স্বাদ পান না।’

অনুরোধের ঢেঁকি

কান উৎসব চলাকালে পালে দো ফেস্টিভ্যাল ভবনের সামনে রোজ সকাল থেকে চোখে পড়ে বিভিন্ন বয়সী মানুষ কাগজ কিংবা প্ল্যাকার্ড নিয়ে হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। সেগুলোতে লেখা ‘টিকেট প্লিজ’, নয়তো ‘ইনভাইটেশন প্লিজ’। সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত ছবির নাম। কেউ কেউ একটু বেশি মনোযোগ আকর্ষণের জন্য অনুরোধের কথা উল্লেখের পাশাপাশি প্ল্যাকার্ড আর কাগজে কার্টুন চরিত্র এঁকে রংচঙে করেন। টিকিট চেয়ে অনুরোধের কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে থাকলে কী হবে, তাদের বেশিরভাগই ক্যামেরাবন্দি হতে চান না।

গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে প্রতিদিন সন্ধ্যা ও রাতে ছবির প্রদর্শনীর আগে বিখ্যাত তারকারা লালগালিচায় পা মাড়ান। তাই এসব প্রদর্শনী দেখা মানে বিখ্যাত তারকাদের সঙ্গেই দেখা! বোনাস হিসেবে পা মাড়ানো যায় লালগালিচায়। সেজন্যই টিকিটের জন্য এত আকুলতা। অনুরোধের ঢেঁকি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সাধারণত আমজনতাই। উৎসবে আমন্ত্রিত সাংবাদিকসহ প্রায় সবারই সব ছবি দেখার সুযোগ থাকে। সাধারণ মানুষও শামিল হতে চান সেই মিছিলে। কপোত-কপোতীরাই ভিড় করেন বেশি। কেউ কেউ উচ্চারণ করে বলতে থাকেন- ‘টিকিট প্লিজ!’

সৈকতের হাওয়ায় বড় পর্দা

কান চলচ্চিত্র উৎসবে দর্শকদের সবচেয়ে আকর্ষণের জায়গা হচ্ছে ‘সিনেমা ডি লা প্লাজ’। ফরাসি কথাটির ইংরেজি হলো ‘বিচ সিনেমা’। বোঝাই যাচ্ছে, এই বিভাগে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হয় সমুদ্র সৈকতে। কান ক্ল্যাসিকস বিভাগের ধ্রুপদি চলচ্চিত্রগুলো প্রদর্শিত হয় সাগরপাড়ে। এগুলো দেখতে দর্শকদের টিকিট দরকার পড়ে না। শুধু হাতে ফাঁকা সময় থাকলেই হলো! তাদের সুবিধার্থে আগে থেকে বসানো থাকে চেয়ার। ম্যাসি সৈকতে প্রতিদিন রাত ৯টায় শুরু হয় প্রদর্শনী। কপাল ভালো থাকলে এসব ছবির তারকাকেও দেখা যায় চোখের সামনে!

আক্ষেপ, লাল-সবুজ পতাকা

মার্শে দ্যু ফিল্ম ভবন থেকে বেরিয়ে ডান দিকে তাকালেই চোখে পড়বে বিভিন্ন দেশের সারি সারি প্যাভিলিয়ন। পালে দো ফেস্টিভ্যাল ভবনের ঠিক সামনে দাঁড়ালে একপাশে ভিলেজ ইন্টারন্যাশনালের একটি অংশ। অন্যপাশে অর্থাৎ লালগালিচা পেরিয়ে গেলে আরেকটি অংশ। দুদিকেই বাতাসে উড়তে দেখি বিভিন্ন দেশের পতাকা। সব দেশের প্যাভিলিয়নের ওপরে ওড়ে সেগুলো। কান উৎসবে এসে শুধু একটাই আক্ষেপ হয় বারবার, প্রিয় লাল-সবুজ পতাকাটা এখনও এখানে ওড়েনি।