বাংলাদেশের ছবিতে কাজের পরিকল্পনা ছিল: নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকি


নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকিজন্ম ভারতের উত্তর প্রদেশের এক কৃষক পরিবারে। ভাগ্যের অন্বেষণে পাড়ি জমান দিল্লিতে। সেখানেই মঞ্চ অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। পরে ভারতের জাতীয় নাট্যশালায় দারোয়ানের চাকরি করতে হয়েছিল দেড় বছর। এই হচ্ছে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকির পেছনের অধ্যায়।

কান উৎসবের ৭১তম আসরে আঁ সার্তেন রিগার্দ বিভাগে নির্বাচিত নওয়াজের নতুন ছবি ‘মান্টো’ নির্বাচিত হওয়ার খবর পেয়ে তার সাক্ষাৎকার নেওয়ার ইচ্ছে হলো। কীভাবে নেবো জানি না!‍ কিন্তু নিতে হবে। উর্দু সাহিত্যিক সাদাত হাসান মান্টোর জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিয়ে ছবিটি বানিয়েছেন নন্দিতা দাস।
কানে টিম ‘মান্টো’গত ৬ মে একটা সম্ভাবনা তৈরি হলো। ‘মান্টো’র জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক অ্যালেক্স রাউলি ইমেইল করেন ওইদিন। ‘মান্টো’ কখন কোথায় দেখাবে সেই সময়সূচির সঙ্গে জানানো হলো, ১৩ ও ১৪ মে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের সময় দেবেন নওয়াজ ও ‘মান্টো’র পরিচালক নন্দিতা দাস। তবে সাক্ষাৎকার নেওয়ার অনুরোধ জানাতে হবে। সময় পাওয়া যাবে কিনা সেই নিশ্চয়তার আভাস নেই ইমেইলে।
গুনে গুনে চারটি ইমেইল করার পর উত্তর এলো। সাড়া দিলেন অ্যালেক্স। অনলাইন মিডিয়া কিনা জেনে পরের ইমেইলে জানালেন ১৪ মে কানের স্থানীয় সময় বিকাল পৌনে পাঁচটায় ম্যারিয়ট হোটেলে বাংলা ট্রিবিউনকে সাক্ষাৎকারের সময় দিয়েছেন নওয়াজুদ্দিনি সিদ্দিকি ও নন্দিতা দাস। তবে ঠিক ১৫ মিনিট আগে পৌঁছাতে হবে।
১৪ মে আধঘণ্টা আগেই পৌঁছে গেলাম। ঠিক পৌনে ৫টায় অ্যালেক্স রাউলি ফোন করলেন। এরপর ক্যাটরিওনা নামে তার একজন প্রতিনিধি এসে ভেতরে নিয়ে গেলেন।
নওয়াজকে প্রথম দেখে আমার অদ্ভুত লাগলো। আমার চেয়েও বেঁটে! মানুষটা দেখতে ছোট। কিন্তু তার মনের জোর অনুসরণীয়। অনেক কষ্ট আর পরিশ্রম করে আজ একটা জায়গায় পৌঁছেছেন তিনি। ‘মান্টো’র একটি স্ট্যান্ড পেছনে। সামনে নওয়াজ। শুরু হলো সাক্ষাৎকার-
‘মান্টো’র একটি দৃশ্যে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকিবাংলা ট্রিবিউন: মান্টোর সঙ্গে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকির মিল কতটা?
নওয়াজুদ্দিন: সাদাত হোসেন মান্টো ও নওয়াজের মধ্যে অনেক মিল! মাঝে মধ্যে সবার মতো আমিও সত্যি কথাটাই বলতে চাই। সারা পৃথিবীতে যারা সত্যের পক্ষে, তারা প্রত্যেকে নিজেকে মান্টো ভাবতে পারেন। বিশ্বজুড়ে সত্যবাদীদের দিকে তাকালে মান্টোর ছায়া খুঁজে পাবেন। মান্টো অনেক সফল মানুষ ছিলেন। এজন্য তার মানবিকতা আলাদাভাবে চোখে পড়ে আমাদের। মান্টো অনেক সেনসিটিভ। রাগীও বটে। অল্পতেই রেগে যেতেন তিনি। একইসঙ্গে আত্মবিশ্বাসী। আবার নারীদের ব্যাপারে তিনি ছিলেন মুক্তমনা।
বাংলা ট্রিবিউন: মান্টো সত্য বলতেন ও লিখতেন। তার চরিত্রে অভিনয় করতে হলে সততা ও আন্তরিকতা প্রয়োজন। তা আপনার প্রস্তুতি কেমন ছিল?
নওয়াজুদ্দিন: মান্টোকে নিয়ে আমরা অনেক হোমওয়ার্ক করেছি। তার শারীরিক ভাবভঙ্গির ওপর জোর দিয়েছি। ঘরে তার মতো পোশাক পরে থেকেছি। তার লেখা ছোটগল্পের সময় অনুযায়ী চল্লিশের দশকে ফিরে যেতে হয়েছে। সবশেষে তার চিন্তাচেতনা আয়ত্ত্বে আনার চেষ্টা ছিল আমাদের।
চরিত্রের জন্য প্রস্তুতির দুটি প্রক্রিয়া থাকে। যেমন, বাচনভঙ্গি যুতসই করে শারীরিক পরিবর্তনে ঢোকা। অথবা শারীরিকভাবে মানানসই হয়ে বাচনভঙ্গিতে যাওয়া। কিন্তু আমরা করেছি উল্টোটা। প্রথমে শারীরিকভাবে পরিবর্তন আনার প্রস্তুতি নিয়েছি।
বাংলা ট্রিবিউন: পরিচালক নন্দিতা দাসের প্রথম ছবি ‘ফিরাক’-এ কাজ করেছেন। ‘মান্টো’তে তো নাম ভূমিকাতেই আছেন। তার পরিচালনার বিশেষত্ব কী?
নওয়াজুদ্দিন: নন্দিতা দাস খুব সেনসিটিভ একজন পরিচালক। শুটিংয়ের আগে ‘মান্টো’র প্রতিটি চরিত্র নিয়ে অনেক স্টাডি করেছেন তিনি। সাদাত হাসান মান্টো সম্পর্কে আমার চেয়েও বেশি জানতেন তিনি। মান্টোকে নিয়ে নিজের জ্ঞান দিয়ে আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। সেই অনুযায়ী আমি চরিত্রায়ন করেছি।
বাংলা ট্রিবিউন: ছবিটি দেখে আপনার নিজের কেমন লেগেছে? আপনি কি আত্মসমালোচক?
নওয়াজুদ্দিন: আমরা সততার সঙ্গে একটি ছবি বানানোর চেষ্টা করেছি। এটি অনেক সৎ ছবি। সত্যি বলতে ক্যামেরার সামনে অনেক কিছু করতে চাই। কখনও তা পারি। কখনও শতভাগ হয় না। ছবি দেখার পর ঠিকই বুঝে ফেলি যে, আমি লক্ষ্যে যেতে পারিনি।
বাংলা ট্রিবিউন: কানে এ নিয়ে আপনার ৯টি ছবি অংশ নিলো। অফিসিয়াল সিলেকশন এই প্রথম...
নওয়াজুদ্দিন: এমন বড় একটি চলচ্চিত্র উৎসবে আমাদের ছবি অফিসিয়াল সিলেকশনে জায়গা পেয়েছে, এটা অবশ্যই গর্বের ব্যাপার। আমি খুব খুশি। কানের আঁ সার্তেন রিগার্দে নির্বাচিত হওয়ায় ‘মান্টো’কে নিয়ে আমি গর্বিত। কানে প্রত্যেকে সিনেমা নিয়েই কথা বলে। আমার ৯টি ছবি কানে প্রদর্শিত হওয়াও অনেক ভালোলাগার ব্যাপার। এতে মনে হয় আমি ঠিক পথেই আছি। এই আয়োজন আমাকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করে এভাবে যে, আমি এমন ছবি করবো যা কানের আগামী আসরে সিলেকশনে থাকবে।

বাংলা ট্রিবিউন:
আপনি বালাসাহেব ঠাকরে চরিত্রেও কাজ করছেন। মান্টো ও বালা ঠাকরের মতো চেনা কিন্তু জটিল মানুষের চরিত্রে নিজেকে কীভাবে মানিয়ে নেন?
নওয়াজুদ্দিন: অভিনেতা হিসেবে ব্যক্তিত্ব হতে হয় জলের মতো, যেন সবকিছুতে মিশে যেতে পারেন। বিখ্যাত মানুষের চরিত্রে কাজ করা বড় ব্যাপার। কারণ অন্যের চিন্তাচেতনা মনের ভেতরে এনে তাদেরকে ফুটিয়ে তুলতে হয়।
বাংলা ট্রিবিউন: এবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসি। বাংলাদেশের ছবি নিয়ে পর্যালোচনা করতে হলে কী বলবেন?
নওয়াজুদ্দিন: বাংলাদেশে অনেক ভালো ছবি তৈরি হয়। নতুন নির্মাতা যারা কাজ করছেন, তাদের মেধার প্রশংসা করতেই হয়। তারা সত্যিকার অর্থেই প্রতিভাবান।
বাংলা ট্রিবিউন প্রতিনিধির সঙ্গে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকিবাংলা ট্রিবিউন: বাংলা ছবিতে বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশের ছবির প্রস্তাব পেলে কাজ করবেন?
নওয়াজুদ্দিন: বাংলাদেশের ছবিতে কাজের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু তা এখনও হয়নি। যদি ভালো কোনও চিত্রনাট্য পাই তাহলে তো এখনও করতে চাই।
বাংলা ট্রিবিউন: শুনেছি, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ছবিতে কাজের প্রস্তাব পেয়েছেন?
নওয়াজুদ্দিন: হ্যাঁ, একসঙ্গে কাজ করার জন্য কয়েকবার পরিকল্পনা হয়েছিল আমাদের মধ্যে। কিন্তু পরে তিনি আর আমি উভয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আগামীতে দেখা যাক কাজটা হয় কিনা। আমরা কিন্তু একটা বিষয় ভেবে রেখেছি। ফারুকী আবারও ভারতে এলে কথা বলবো।
বাংলা ট্রিবিউন: পরিচালনায় আসতে চান?
নওয়াজুদ্দিন: না-না। আমার এ নিয়ে কোনও পরিকল্পনা নেই।
বাংলা ট্রিবিউন: বাংলাদেশে আপনার অসংখ্য ভক্ত। তাদের উদ্দেশে কিছু বলুন।
নওয়াজুদ্দিন: আমি যে ধরনের ছবিতে কাজ করি তা একটু আলাদা। এগুলো দেখে আপনারা আমাকে উৎসাহিত করে আসছেন, এজন্য বরাবরই ভালো কাজের চেষ্টা করি। বাংলাদেশ-ভারতের নবীন-প্রবীণ সবাই পরিশ্রম করে সিনেমা বানায়, তাদের ছবি দেখে যেভাবে উৎসাহ দিচ্ছেন, এভাবেই ভালোবাসা বিলিয়ে দিন।