বছর যায়, কিন্তু বিশ্ব চলচ্চিত্রের সবচেয়ে সম্মানজনক এই আয়োজনের সঙ্গে যারা যে দায়িত্বে নিয়োজিত, তারা ফিরে আসেন প্রতিবার। তাই কান সৈকতে ঘুরেফিরে চোখে পড়ে একই মুখ! এজন্য এবার এমনও হয়েছে, মূল ফটকে যারা আর্চওয়ের সামনে ভবনে প্রবেশরত মানুষের ব্যাগ পরীক্ষা করেন, তারা শেষের কয়েকদিন তো ব্যাগ দেখাতে গেলেই ‘নো নিড’, ‘নো নিড’ বলতেন। তবুও আনুষ্ঠানিকতা মেনে ব্যাগ খুলতে গেলে বিব্রতবোধ করলেন তারা। একজন জানালেন, খুব বেশি প্রয়োজন না হলে আর আমার ব্যাগ খুলে জিনিসপত্র দেখানোর দরকার নেই।
প্রেস রুমের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আশপাশে তাকিয়ে খুব একটা ভিড়ভাট্টা চোখে পড়লো না। সমাপনী দিনে কিছুটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে সব। ভবনের সামনের অংশ প্রায় ফাঁকা। আশেপাশে জনসমাগমও খুব কম। ইনভাইটেশন প্রত্যাশীরাও নেই। চারদিকে কেমন যেন নীরব শূন্যতা। স্কেটিংয়ের মাধ্যমে যেতে যেতে তিন তরুণী পত্রিকা বিলি করছে। হলিউড রিপোর্টার, গ্রাজিয়া, ভ্যারাইটিসহ চলচ্চিত্র বিষয়ক বিখ্যাত পত্রিকাগুলো প্রতিদিনই কান উৎসব নিয়ে বিশেষ সংখ্যা ছাপিয়ে বিনামূল্যে সাংবাদিকসহ সিনেমানুরাগীদের বিলিয়ে দিয়েছে।
প্রেস রুমে ফিরে দেখা হলো ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিক রড্রিগোর সঙ্গে। গত তিনবারও আমাদের দেখা হয়েছে। আমরা আড্ডায় পাম দ’রের ভবিষ্যদ্বাণী করলাম কিছুক্ষণ। বিকালে ফিপরেস্কি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গিয়ে চীনা সাংবাদিক শুশাঙ রাঙের সঙ্গে কথা হলো। তার সঙ্গেও গত তিনবার আড্ডা হয়েছিল। এবারও পাম দ’র নিয়েই প্রেডিকশন। তাকে কেন যেন বললাম, এবার স্বর্ণ পাম এশিয়ায় আসবে! কিন্তু তিনি খুব একটা আশাবাদী হলেন না এ বিষয়ে। পালে দো ফেস্টিভ্যাল ভবনের চতুর্থ তলায় সাল দো আম্বাসেডরে ফিপরেস্কি দেওয়া হয়। এই জায়গাটা তখন ছিল লোকে লোকারণ্য। সঙ্গে শ্যাম্পেনের গ্লাস।
সাল দো অ্যাম্বাসেদরে ব্যালকনিতে দাঁড়ালে ভূমধ্যসাগরের সৌন্দর্য চলে আসে দৃষ্টির সীমানায়। সাগরের তীরে আছে হেলিপ্যাড। তার ওপরে অসংখ্য কবুতর। কানের এখানে-সেখানে অসংখ্য কবুতর চোখে পড়ে। লর্ড ব্রোগহাম স্কয়ারের সামনেও বেশকিছু কবুতরের আনাগোনা থাকে। ১৮৬৮ সালের মে মাসে কানে মৃত্যুবরণ করেন গ্রেট ব্রিটেনের এই লর্ড চ্যান্সেলর। তার সম্মানে তৈরি করা হয়েছে একটি ভাস্কর্য, এর সামনে ছোট জলবাগান। অন্য পাশে একটি পানির ফোয়ারা। এ দুটি স্থাপনার পাশেই ম্যাকডোনাল্ড’স। প্রতিদিন সেখানে খেতে গেলে কবুতরগুলো স্বাগত জানায়।
কান উৎসবের আরেক মায়াবী জায়গা টকটকে লালগালিচা। সেখানে বিশ্ব চলচ্চিত্রের তারকা-মহাতারকাদের পায়চারির ছবি বিক্রি হয় এমন একটি বুটিক শপ প্রতিবারই দেখেছি। এই দোকানের ভেতরে মোবাইল ফোন দিয়ে ছবি তোলা বারণ। এখানে গত ৮ মে উৎসবের উদ্বোধনী থেকে শুরু করে প্রতিদিনের লালগালিচার ছবি সাজানো আছে তারিখ অনুযায়ী। ছোট আকারের একেকটি ছবির জন্য নেওয়া হচ্ছে ২৫ ইউরো (বাংলাদেশি মুদ্রায় দুই হাজার টাকারও বেশি)। মাঝারি আকারের প্রতিটির মূল্য ৩০ ইউরো (তিন হাজার টাকারও বেশি)। আর একটু বড় আকারের ছবি নিতে গেলে গুনতে হবে ৪০ ইউরো করে (চার হাজার টাকারও বেশি)। ইমেইল, সিডি কিংবা পেনড্রাইভে চাইলেও এখান থেকে লালগালিচায় তারকাদের পা মাড়ানোর ছবি কেনা যায়। এজন্য প্রতিটি ছবির বেলায় লাগবে ৩০ ইউরো।
উৎসবের প্রাণকেন্দ্র পালে দো ফেস্টিভ্যালে ফিরে সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় নেমে দেখি মার্শে দ্যু ফিল্ম আর শর্ট ফিল্ম কর্নার প্রায় নিষ্প্রাণ। সবাই ইতোমধ্যে ছেড়ে গেছেন কান। চারপাশে বিদায় বিদায় ভাব। ততোক্ষণে সমাপনী অনুষ্ঠান শুরুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। শেষ সময়টা কাটলো তুমুল ব্যস্ততায়। ইচ্ছে ছিল প্রতিটি পুরস্কার বিজয়ীর নাম ঘোষণার পরেই নিউজ পাঠিয়ে দেবো। বিশ্বের যে কোনও সংবাদমাধ্যমের আগে তা প্রকাশের একটা নিরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম। বাংলা ট্রিবিউনে যথাসময়ে নিউজগুলো প্রকাশের পর বিখ্যাত সংবাদ সংস্থাগুলো ঘেঁটে দেখলাম- আমরাই সবার আগে, আমরা সফল!
দক্ষিণ ফরাসি উপকূলের শহর কানে এবার থাকলাম ১৬ দিন। দিনভর ছবি দেখা, সংবাদ সম্মেলনে যাওয়া, এদিক-সেদিক ঘোরাফেরার ফাঁকে লিখে রাতে হোটেলে ফিরে আবারও বসে পড়তে হতো ল্যাপটপ নিয়ে। রাতে সব মিলিয়ে ঘুমানোর সুযোগ ছিল মাত্র চার ঘণ্টা। ভোর হলেই আবার দে ছুট! উৎসব শেষে মনে হলো শরীর জুড়ে ক্লান্তির পাহাড়।
২০ মে সকালেই চলে এলাম কানে। ট্রেনে চড়ে প্যারিস যাবো। দুপুর ১২টা ২৭ মিনিটে ছাড়বে ট্রেন। গার দি কানে (ট্রেন স্টেশন) পৌঁছার সময় রোজ দেখা হয়েছে মেরিলিন মনরোর সঙ্গে! রিভিয়েরা হোটেলের দেয়ালজুড়ে প্রয়াত কিংবদন্তি এই অভিনেত্রীর বিশাল ছবি দেখে মনে হবে তিনি জীবন্ত! শেষ দিনেও মনরোর চোখে চোখ পড়লো।