ও আসলে মরেনি, এটা তার অভিমান





সোলস ব্যান্ডের সদস্যরা, ডান থেকে দ্বিতীয় আইয়ুব বাচ্চু এবং তৃতীয় তপন চৌধুরীমানুষের ভালোবাসা থাকলে একজন মানুষ কোন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে, তার চাক্ষুষ প্রমাণ রেখে গেল আইয়ুব বাচ্চু। একেবারে শূন্য থেকে সে আকাশের তারায় পরিণত হয়েছে। এটা আমার জন্য অনেক গর্বের বিষয়।
আমার আগেই তার এভাবে চলে যাওয়াটা সত্যিই বেদনার। মনে পড়ে গত বছর এমন দিনে (১৮ অক্টোবর) আমি ঢাকাতেই ছিলাম। সকালের একটা অনুষ্ঠানের শুটিংয়ে বাংলাভিশন যাই। চ্যানেলে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে এক প্রযোজক হন্তদন্ত হয়ে এসে বলেন, ‘বাচ্চু ভাইর খবর জানে নাকি?’ বললাম, কেন! কী হলো? মৃত্যুর বিষয়টি মাথাতেই এলো না। আমি ভাবলাম, বাচ্চুর কোনও গান বা অ্যালবামের কথা বলছে হয়তো।
পরে প্রযোজক বললো, ‘বাচ্চু ভাই তো নেই। মারা গেছেন! সব টিভিতে স্ক্রল যাচ্ছে।’ আমি দৌড়ে টিভি সেটের সামনে গেলাম। দেখলাম, খবর সত্যি। মনে পড়ে, দাঁড়ানো থেকে পাশের চেয়ারে আমি বসে গেলাম। ব্ল্যাকআউট হয়ে গেলাম। মিনিমাম পাঁচ মিনিট বোবা হয়ে গেলাম। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এটা কেমন চলে যাওয়া?
সময় নষ্ট না করে ছুটে গেলাম স্কয়ার হসপিটালে। গিয়ে দেখলাম, বাচ্চু নিথর শুয়ে আছে। ঝকঝকে মুখ, হাত। একেবারে নিট অ্যান্ড ক্লিন। মনে হলো, ও বুঝি স্টেজে ওঠার জন্য রেডি হয়ে আছে! আমার তখন প্রচণ্ড ইচ্ছে করছিলো ওর হাত-মুখ ধরে একটু আদর করি।
বোকার মতো একজন চিকিৎসককে ডেকে বললাম, আমি কি ওর মুখটা ধরে একটু আদর করতে পারি? চিকিৎসক অনুমতি দিলেন। আমি ওর মুখটা দুই হাতে ধরলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। শুধু শক্ত করে শেষবারের মতো বুকে জড়িয়ে ধরতে পারিনি।
টানা ৪০ বছরের সম্পর্কটা এভাবেই চুকে গেল সেদিন।
সেদিন বাচ্চুর নিথর দেহের পাশে দাঁড়িয়ে আমার মনে হচ্ছিল, ও আসলে মরে যায়নি। এটা ওর অভিমান। ওর মধ্যে এত অভিমান ছিল, যা বলে বোঝাতে পারবো না। কথায় কথায় অভিমান করতো। এমনকি কষ্ট পেলে সেসব শেয়ার করতে গিয়ে কেঁদে ফেলতো। ও ছিল শিশুদের মতো। আমি ঠিক জানি না, কোন অভিমানে সে এভাবে এত দ্রুত চলে গেল।
সব অভিমানের গল্প চুকে এখন নিশ্চয়ই সে ভালো আছে। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
ও চলে যাওয়ার পর এলআরবি নিয়ে যা হলো সেটা নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুব্ধ। আবার এটাও ঠিক, এমনটাই তো হওয়ার কথা। একটা ঘরের প্রধান মানুষ না থাকলে যা হয়, তা-ই হচ্ছে। অথচ আমরা সবাই চাইলে বাচ্চুর সৃষ্টি ও এলআরবিকে অনেক সুন্দরভাবে কনটিনিউ করা যেত। আফসোস, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে সেই মানসিকতার লোকের বড্ড অভাব।
বাচ্চুকে নিয়ে সোলস-এ একসঙ্গে প্রায় ১৫ বছর কাটিয়েছি। আমার প্রথম অ্যালবামের পুরোটার দায়িত্ব তাকে দিয়েছি। এরপর আমরা ৪০ বছরের সংগীত জীবন কাটিয়েছি পাশাপাশি।
কানাডা থেকে ঢাকায় ফেরার পর সেই সংগীত সহযাত্রীকে ছাড়া, বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ২১ অক্টোবর ঢাকায় আসবো। চেষ্টা করবো বাচ্চুর স্মরণে একটা কিছু করার।
লেখক: সংগীতশিল্পী
অনুলিখন: মাহমুদ মানজুর