কিন্তু বাংলাদেশে এখনও সেই বিকল্প রাস্তা গড়ে ওঠেনি। একটি সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে না মুক্তি দিয়ে শুধু কোনও অ্যাপে প্রকাশের পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি এখানে। তাই সামনের দুই ঈদকে ঘিরে বেশ বিচলিত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। কারণ, সারা বছরের এই দুটি উৎসবেই লভ্যাংশ কিংবা মূলধন ঘরে তোলেন সংশ্লিষ্টরা। দর্শকরাও বড় ক্যানভাসের ছবির জন্য সারা বছর অপেক্ষায় থাকে ঈদ উৎসবের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় মুনাফা লাভের ময়দান রোজার ঈদ থাকছে ফাঁকা। প্রেক্ষাগৃহে উঠছে না নতুন কিংবা পুরাতন কোনও ছবি। সরকারি বা সাংগঠনিকভাবে ঘোষণা এখনও না এলেও বিষয়টি সে পথেই এগুচ্ছে বলে জানিয়েছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা।
ইতোমধ্যে রোজার ঈদের বড় বাজেটের ছবি ‘মিশন এক্সট্রিম’ পিছিয়ে গেছে। আরও মুক্তির কথা ছিল দেশের প্রধান নায়ক শাকিব খানের ‘বিদ্রোহী’ ও ‘নবাব এলএলবি’ নামের দুটি ছবি। শাকিব খান জানান, গত ১৫ বছরে এবারই প্রথম, যে ঈদে তার সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে না। যদিও বিষয়টি নিয়ে তার মধ্যে কোনও আক্ষেপ নেই। তিনি বিষয়টিকে দেখছেন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে।
তার ভাষ্যে, ‘আগে মানুষের জীবন, পরে সিনেমা। মানুষই যদি না দেখতে পারে, তাহলে সেই সিনেমা মুক্তি দিয়ে কী হবে? আর এটা তো শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা বিশ্বেই একই অবস্থা। সব থমকে গেছে। সবখানে বাঁচার আকুতি। তবে এটুকু কথা দিচ্ছি, এই খারাপ সময় কেটে গেলে, এই যাত্রায় বেঁচে গেলে, নতুন উদ্যমে সবাই মিলে চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ে কাজ করবো।’
আগের ছবি হলেও ঈদকে কেন্দ্র করে মুক্তির আলোচনায় ছিল সিয়াম আহমেদের ‘শান’ ও ইয়াশ রোহানের ‘পরাণ’। তবে করোনার কারণে কেউ মুক্তির কথা এখন আর ভাবছেন না।
এই ঈদে মুক্তি প্রতীক্ষিত সবচেয়ে আলোচিত ছবি ‘মিশন এক্সট্রিম’। এর অন্যতম পরিচালক, প্রযোজক ও কাহিনিকার সানী সানোয়ার।
তিনি বলেন, ‘‘সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে করোনাভাইরাস। আমাদের আরও সহনশীল হতে হবে। তাই দেশের এমন পরিস্থিতিতে রোজার ঈদে আসছে না ‘মিশন এক্সট্রিম’। সবকিছু ঠিক হলে আমরা আবারও মুক্তির জন্য প্রস্তুতি নেবো। এখন আমরা পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।’’
এবার শাহীন সুমন পরিচালিত ‘বিদ্রোহী’ ছবিও আসছে না। একই পরিচালকের ‘পাগলের মতো ভালোবাসি’ও তৈরি আছে ঈদের জন্য।
এই নির্মাতার ভাষ্য, ‘ঈদে আমার কোনও ছবি আসছে না এটা নিশ্চিত। কবে আসবে তাও জানি না। আমরা আসলে কেউ-ই জানি না এই দুঃসময় কবে যাবে। তবে এটুকু নিশ্চিত, ঈদে কোনও ছবি রিলিজ হচ্ছে না।’
তবে প্রত্যেকেই অপেক্ষা করছেন ভালো সময়ের। আর এটা ঈদের মধ্যে সম্ভব নয় বলেও ধারণা তাদের। নির্মাণ হয়ে থাকা ছবিগুলো বিপণনের বিকল্প পথও খুঁজে পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। দেশের বেশ কয়েকটি স্ট্রিমিং অ্যাপ সিনেমার ডিজিটাল রাইট কিনলেও, সেটি মুক্তি পাওয়া জনপ্রিয় ছবির ক্ষেত্রেই বেশি প্রযোজ্য হয়। একেবারে নতুন ছবি কিনে সেটি অ্যাপে মুক্তির পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি দেশে। কারণ হিসেবে জানা গেছে, অ্যাপ-এ বাংলাদেশের সিনেমা দেখার দর্শক এখনও তৈরি হয়নি দেশে।
এ তো গেল নির্মাতাদের বক্তব্য। হল মালিকরা কী ভাবছেন? জানতে চাওয়া হয়েছিল দেশের অন্যতম প্রেক্ষাগৃহ মধুমিতার কর্ণধার, প্রদর্শক সমিতির সাবেক নেতা ও সেন্সর বোর্ডের সদস্য ইফতেখার উদ্দিন নওশাদের কাছে। তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি আমাদের পক্ষে নেই। ঈদে কী ঘটবে তার সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি।’
এদিকে পরিস্থিতি নিয়ে একই চিন্তা প্রযোজক নেতা খোরশেদ আলম খসরুর। পাশাপাশি তিনি সরকারি দিকনির্দেশনাও চান।
খসরু বললেন, ‘প্রথমত আমরা সরকারি সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাবো। যদি লকডাউন শেষ হয়, তাহলে ভালো। দ্বিতীয়ত আমরা ভাববো, হলে আদৌ মানুষ যাওয়ার পরিবেশ আছে কিনা? দর্শকরা যাবেন কিনা? এ সবই এখন আমাদের অনুকূলে নেই। এরপরে থাকে প্রযোজক ও নির্মাতাদের প্রস্তুতি। এগুলো কোনোটাই আমরা করতে পারছি না। একজন প্রযোজক এত টাকা লগ্নি করে শূন্য হলে ছবি রিলিজ কি দেবেন? মনে হয় না। তাই সরকারি বা আমাদের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসুক বা না আসুক, এবার ঈদে ছবি রিলিজ হচ্ছে না।’
গত পাঁচ বছরে চলচ্চিত্রের অবস্থা এমনিতেই টালমাটাল। ২০১৫ সালের ঈদে দেশজুড়ে মুক্তি পেয়েছিল তিনটি ছবি। এগুলো হচ্ছে- শাহিন সুমন পরিচালিত ‘লাভ ম্যারেজ’, ‘ইফতেখার চৌধুরী পরিচালিত ‘অগ্নি টু’ এবং তন্ময় তানসেন পরিচালিত ‘পদ্মপাতার জল’।
দর্শক উপস্থিতিতে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সন্তুষ্ট হলেও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো লাভের মুখ দেখেনি।
২০১৬ সালের ঈদুল ফিতর ছিল বেশ আলাদা, ঈদে মুক্তি পেয়েছিল চারটি ছবি। এগুলো হচ্ছে- জয়দীপ মুখার্জি পরিচালিত ‘শিকারী’, বাবা যাদব পরিচালিত ‘বাদশা দ্য ডন’, মোস্তফা কামাল রাজ পরিচালিত ‘সম্রাট’ ও শামীম আহমেদ রনি পরিচালিত ‘মেন্টাল’। এরমধ্যে লাভের অঙ্কটা বের করে আনতে পারে শাকিবের ‘শিকারী’ ও জিতের ‘বাদশা দ্য ডন’।
২০১৭ সালের রোজার ঈদে আসে তিনটি ছবি। এগুলো হচ্ছে জয়দীপ মুখার্জি পরিচালিত ‘নবাব’, বাবা যাদব পরিচালিত ‘বস টু’ ও বুলবুল বিশ্বাস পরিচালিত ‘রাজনীতি’। ‘নবাব’ সুপর-ডুপার হলেও ব্যর্থ হয় ‘বস টু’। সফল হয় ‘রাজনীতি’। সব মিলেয়ে মোটামুটি ব্যবসা করে।
২০১৮ সালে প্রথম মুক্তি পেয়েছিল চারটি ছবি। এগুলো হচ্ছে উত্তম আকাশ পরিচালিত ‘চিটাগাইঙ্গা পোয়া নোয়াখাইল্যা মাইয়া’, আব্দুল মান্নান পরিচালিত ‘পাঙ্কু জামাই’, আশিকুর রহমান পরিচালিত ‘সুপারহিরো’ এবং রায়হান রাফি পরিচালিত ‘পোড়ামন টু’। বক্স অফিস যেন আরও খেই হারিয়ে ফেলে।
২০১৯ সালের ঈদুল ফিতরে মুক্তি পেয়েছে তিনটি ছবি। মালেক আফসারীর ‘পাসওয়ার্ড’, সাকিব সনেট পরিচালিত ‘নোলক’ এবং অনন্য মামুন পরিচালিত ‘আবার বসন্ত’। এরমধ্যে শাকিব খান প্রযোজিত ‘পাসওয়ার্ড’ ভালো ব্যবসা করে।
দেশীয় চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির খারাপ সময়ের এই ধারাবাহিকতাকে আরও গভীর ক্ষতে পরিণত করলো করোনাভাইরাস। কারণ, এবার একেবারে হলশূন্য থাকবে ঈদ উৎসব।
তাই চলচ্চিত্র নেতা ও শিল্পীদের মতে, বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ২০২০ সালের ঈদের মতো খারাপ অবস্থায় কখনও যায়নি। যেন একেবারে বিষণ্ণ এক অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে সিনেপ্রেমী ও নির্মাতাদের।