চারুলতাকে অমল চিঠি লিখবে। শুট চলছে ‘চারুলতা’র। বাবা (সত্যজিৎ রায়) গম্ভীর গলায় সৌমিত্র কাকুকে বললেন, ‘তোমার এই হাতের লেখায় হবে না। সেই সময়ের হাতের লেখার মতো করে চিঠি লিখতে হবে।’ এরপর বাবা হাতে ধরে ক্যালিগ্রাফি শিখিয়েছিলেন সৌমিত্র কাকুকে। খুব মন দিয়ে তখন দেখেছিলাম ‘চারুলতা’ ছবির অমল সেই হাতের লেখা রপ্ত করলেন। পরবর্তীকালে খেয়াল করে দেখলাম, সৌমিত্র কাকুর হাতের লেখাটাই বদলে গেল! ‘অমল’-এর মতো করেই লিখতে শুরু করলেন।
এমনই ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। গলার স্বর, কথা বলার ভঙ্গি—সবকিছু প্রথম থেকেই অসাধারণ ছিল, ওকে কোনও চেষ্টাই করতে হয়নি, তা কিন্তু একেবারেই নয়। ‘অপুর সংসার’-এর সময় বাবা বলতেন, ওর গলার আওয়াজ বড্ড পাতলা। ও মা! সেই সৌমিত্র কাকু একজন দক্ষ আবৃত্তিকার হয়ে উঠলেন! এই যে নিজেকে তৈরি করার বিষয়টা, এটাই আমায় আশ্চর্য করতো। গলার আওয়াজ নিয়ে নানা চর্চা, বিভিন্ন দিকে তার শ্রম তাকে কেবল একজন অভিনেতা নয়, একজন শিল্পী হয়ে ওঠার দিকে নিয়ে গেলো! নিজের সঙ্গে নিজের চ্যালেঞ্জ ছিল তার। কিছু হয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ।
৬০ বছরের যোগাযোগ আমাদের। চলচ্চিত্রের জন্য তো আসতেনই। যখন থেকে ‘এক্ষণ’ প্রকাশ হলো, তখন থেকে আমাদের বাড়িতে ওর আসা বেড়ে গেলো। বাবা ‘এক্ষণ’-এর নামকরণ করে দিলেন। কভারও এঁকে দিলেন। বাবা যখন ওকে চিত্রনাট্য হাতে দিতেন, তখন দেখেছি উনি সেই চিত্রনাট্যের ওপরও কাজ করতেন। মানে, সংলাপগুলো স্ক্যান করে নিতেন। হয়তো চা খাওয়ার দৃশ্য আছে। কোন সময়ে চায়ে চুমুক দেবেন, সেটাও ওর লেখা থাকতো। জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে শার্টের কোন হাতা আগে গোটাবেন, সেটাও ফুটনোটে থাকতো। আমার মনে হয় ওর অসম্ভব স্মৃতিশক্তিও বাবাকে মুগ্ধ করেছিল। ‘ঘরে বাইরে’-র শুট চলছে। ‘সন্দীপ’-এর সেই প্রথম বক্তৃতা। ওই বড় চাঙ্ক দ্রুত মুখস্থ করে ফেললেন। শুধু তা-ই নয়, ডাবিংয়ের সময় ওয়ান টেকে ‘ওকে’ হয়ে গেল! এই ডেডিকেশন আর পাওয়া যাবে না।
অনেকেই বাবাকে সৌমিত্র কাকুর ‘মানসপিতা’ বলেন। আর সৌমিত্র কাকুকে বাবার ‘মানসপুত্র’।
পরিচালক আর অভিনেতার ওই নির্ভরতা দেখে আমারও মনে হতো, দু’জনের মধ্যে কেমন যেন পিতা-পুত্রের সম্পর্কই তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
সৌমিত্র কাকুর ছবি সব সময় বাবার কাছে থাকতো। যখনই যে চরিত্রে তাকে ভাবতেন, মেকআপের জন্য ওই ছবির ওপরই আঁকাআঁকি শুরু করে দিতেন। বিশেষ ধরনের মেকআপের জন্য, যেমন ‘অশনি সংকেত’-এ সৌমিত্র কাকুকে নিজের সামনে মডেলের মতো বসিয়ে ছবি এঁকেছিলেন বাবা। বাবার এই স্নেহ, নির্ভরতা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সৌমিত্র কাকুও।
‘অশনি সংকেত’-এর সময় আমি দেখেছি, নিয়ম করে ওকে ডায়েরি লিখতে। পরে কতবার বলেছি ওই ডায়েরি খুঁজে বার করুন। জানি না সেই ডায়েরি এখন কোথায়! ‘অপু’ ছাড়া ‘অশনি সঙ্কেত’-এর ‘গঙ্গাচরণ’ ছিল ওর সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র। ওই ছবির শুটের সময় সারাক্ষণ উনি শুটিং স্পটে। একদিন এমনও হয়েছিল, যে লম্বা ট্রলির শুট। সেদিন লোক কম। ও মা! উনিই দেখলাম ট্রলি টানতে শুরু করলেন। বাবা বলে উঠলেন, ‘তোমরা হিরোকে দিয়ে ট্রলি ধরার কাজ করালে!’ এতটাই একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন সৌমিত্র কাকু। আমাদের ইউনিট মানেই ওর কাছে পরিবারের সঙ্গে থাকা।
এখনও ভুলতে পারি না ৩০ সেপ্টেম্বরের কথা। সৌমিত্র কাকুকে নিয়ে আর্কাইভ হচ্ছে খুব সম্ভবত। ওর মেয়ে পৌলমী করছে। ও-ই বললো, এটা শুট হবে। আমি আর বেণু (সব্যসাচী চক্রবর্তী) সৌমিত্র কাকুর ছবির কাজ নিয়ে ওকেই প্রশ্ন করবো। ভারতলক্ষ্মী স্টুডিওয় পৌঁছে দেখি উনি সকাল থেকে শুট করছেন। আমাদের শেষ পর্যায়ে কাজ ছিল। আমি আর বেণু মেকআপ রুমে অপেক্ষা করছি। ভাবলাম, একটু জিরিয়ে নিন সৌমিত্র কাকু। তারপর আমরা ফ্লোরে যাবো। দেখি উনি নিজেই চলে এলেন। বললেন, ‘তোমরা এখানে কেন? চলো শুরু করি।’
মাস্ক নেই কেন সৌমিত্র কাকু?
‘আমার ৮৫ বছর হয়ে গেলো! আমার আর মাস্ক পরে কী হবে? নতুন করে কী আর সচেতন হবো? ধুর!’
লেখক: সত্যজিৎ-পুত্র ও চলচ্চিত্র পরিচালক
লিখেছেন: আনন্দবাজার পত্রিকার জন্য