ধরাধামের মায়া কাটিয়ে না-ফেরার দেশে চলে গেলেন ‘সুরের সরস্বতী’। চিরতরে বিদায় নিলেন লতা মঙ্গেশকর। তিনি ছিলেন শিল্পীদের শিল্পী। প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর প্রয়াণে শোকাচ্ছন্ন শিল্পীরা। তার সঙ্গে আলাদা যোগাযোগ ছিল বাংলাদেশের সংগীতশিল্পী রুনা লায়লার। এই মৃত্যুর খবরে তিনি শোকাহত। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শোক জানাতে বেশ কিছু স্মৃতি নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তিনি। এতে রয়েছে তাদের মধ্যকার শেষবারের আলাপচারিতাও।
রবিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) সকালে সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণের খবর পেয়ে মুষড়ে পড়েন রুনা লায়লা। আজ বাংলাদেশ সময় বিকাল ৩টা ১০ মিনিটে ফেসবুকে তিনি শুরুতেই লিখেছেন, ‘যে কণ্ঠ আমার মতো কোটি কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে, তিনি হয়তো এখন স্বর্গে সুরের মূর্ছনা ছড়াবেন। বছরের পর বছর ভালোবাসা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ একটি সুন্দর বন্ধন গড়ে ওঠে আমাদের। আমরা যেন একে অপরের বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম।’
লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে প্রতিদিনই মোবাইল ফোনে মেসেজ আদান-প্রদান হতো রুনা লায়লার। ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমরা প্রায় প্রতিদিনই মেসেজ আদান-প্রদান করতাম। ফোনে দীর্ঘ কথোপকথনে সাধারণত গান নিয়ে আলাপ হতো আমাদের। তার অনুমতি নিয়ে জোকস পাঠানোরও সাহস করেছিলাম, যেগুলো তিনি বেশ উপভোগ করেছেন। দিদির দারুণ রসবোধ ছিল। এ বিষয়ে নিজের কিছু অভিজ্ঞতা আমার সঙ্গে ভাগাভাগি করেছেন। আমরা বেশ হাসিখুশি সময় কাটাতাম। তাঁর কথা শুনতে ভালো লাগতো আমার। সেই মধুর ঝরনার মতো কণ্ঠ আমার কানে যেন গান হিসেবে বাজতো।’
প্রায়ই সকালে লতা মঙ্গেশকরকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠাতেন জানিয়ে রুনা লায়লা লিখেছেন, ‘তাঁকে শুভ সকাল মেসেজ পাঠালে উত্তরে তিনি আমাকে নিজের পছন্দের জিনিসগুলোর ছবি পাঠাতেন। যেমন ফুল ও শিশু এবং নিজের গানের অডিও-ভিডিও। এসবের বেশিরভাগই শুনেছি ও মুখস্থ করেছি আগেই। তাই তার কাছ থেকে সেসব আসাটা ছিল আমার জন্য বাড়তি পাওয়া।’
প্রতি বছর রুনা লায়লার জন্মদিনে তাকে শাড়ি উপহার পাঠাতেন লতা মঙ্গেশকর। গত বছর জন্মদিনটা (১৭ নভেম্বর) লন্ডনে কাটিয়েছেন রুনা লায়লা। তাই তাকে লতা বলেছিলেন, ‘যেহেতু তুমি লন্ডনে যাচ্ছো, ঢাকায় ফিরে এলে তোমাকে উপহার পাঠাবো।’ কথাটা ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানিয়ে রুনা লায়লা লিখেছেন, ‘তাঁকে তখন বলেছি– দিদি, আমার কাছে সবচেয়ে বড় উপহার হলো আপনি নিজেই।’
লতা মঙ্গেশকরের চিরপ্রস্থানের খবর শোনার পর থেকে ভীষণ মনমরা রুনা লায়লা। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘আমার মধ্যে এমন এক বিমর্ষ অনুভূতি ও শূন্যতা ভর করেছে, যা কখনও ফুরানোর নয়। আমি সেই সুন্দর কণ্ঠ আর শুনতে পারবো না। দিদির মুখে আর শোনা হবে না– রুনাজি আপ ক্যায়সি হ্যায়?”
স্ট্যাটাসের শেষভাগে লতা মঙ্গেশকরকে উদ্দেশ করে রুনা লায়লা বলেন, ‘দিদি, আপনি আমাকে এবং আরও অনেককে অনেক কিছু দিয়েছেন। আপনি আমাকে অনেকের চেয়ে বেশি দিয়েছেন, এজন্য আমি কৃতজ্ঞ। আপনি আমাকে শেষ ভয়েস মেসেজগুলোতে যে আশীর্বাদ পাঠিয়েছেন সেজন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি আপনার আশীর্বাদ ও ভালোবাসা আমৃত্যু লালন করবো, সরস্বতী মা।’
ফেসবুকে রুনা লায়লা সবশেষে লিখেছেন, ‘আমার দিদি।’
মুম্বাইয়ের পেডার রোডে প্রভুকুঞ্জে থাকতেন লতা মঙ্গেশকর। ২০১৭ সালের ২৭ মার্চ সেখানে গিয়ে তাঁর সঙ্গে শেষবার দেখা করেন রুনা লায়লা। প্রভুকুঞ্জে বসার ঘরে ঢুকেই লতার পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নেন তিনি। তখন তাকে জড়িয়ে ধরেন লতা। আড্ডা শেষে রুনাকে একটি শাড়ি, নিজের আত্মজীবনী, ভাগ্নির লেখা বই এবং নিজের গানের সিডি উপহার দেন তিনি। তাঁকে একটি জামদানি শাড়ি উপহার দেন রুনা। তারা একসঙ্গে বেশ কিছু ছবি তোলেন। তাঁর বাসায় আড়াই ঘণ্টা ছিলেন রুনা লায়লা। তার কথায়, ‘দিদির সঙ্গে দেখা করতে পারা ছিল আমার কাছে বরাবরই অনেক সম্মানের ব্যাপার।’
২০১৭ সালের ১৭ নভেম্বর লতা মঙ্গেশকরের উপহার দেওয়া শাড়ি পরে নিজের ৬৫তম জন্মদিন উদযাপন করেন রুনা লায়লা। এরপর দিদিকে জন্মদিনের অনেক ছবি পাঠিয়েছিলেন তিনি। সেগুলোর মধ্যে দুটি ছবির টোন বদলে ফ্রেমে বাঁধাই করে আরেকটি শাড়িসহ রুনা লায়লাকে উপহার পাঠান লতা মঙ্গেশকর।
২০১৬ সালের মার্চে মুম্বাইয়ে দাদাসাহেব ফালকে অ্যাওয়ার্ডসের বিচারক হিসেবে কাজ করার ফাঁকে লতা মঙ্গেশকরের বাড়িতে গিয়েছিলেন রুনা লায়লা। ২০১১ সালে প্রভুকুঞ্জে প্রথমবার যান তিনি।
১৯৭৪ সালে মুম্বাইয়ে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে রুনা লায়লার প্রথমবার দেখা হয়। ভারতীয় বিদ্যাভবনে প্রথমবার সংগীত পরিবেশন করতে গিয়েছিলেন রুনা লায়লা। এরপর আশির দশকে কলকাতায় সল্টলেক স্টেডিয়ামে জ্যোতিবসুর আয়োজনে তিন দিনের অনুষ্ঠানে প্রথম দিন ছিল তার পরিবেশনা। শেষ দিন লতা মঙ্গেশকর ও তার বোন আশা ভোঁসলের গান শুনতে উপস্থিত ছিলেন রুনা লায়লা। পরে জ্যোতিবসুর অনুরোধে মঞ্চে উঠে দুই বোনের পা ছুঁয়ে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান তিনি।