দুই দশকে দুই বাংলার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সফল জ্যোতিষ বলা যায় জয়া আহসানকে। যদিও এই জ্যোতিষ নিজের হাতটাই দেখতে পারেন; স্পষ্ট টের পান- নিজস্ব আগামী! মগজ খাটান, সততার সঙ্গে পা বাড়ান, মুকুটে তুলে নেন রাশি রাশি সফলতার সোনালি পালক। তা না হলে কোনও অভিনেত্রী নায়ক-শাসিত দুটো ইন্ডাস্ট্রি অমন করে হাতের মুঠোয় ধরে রাখতে পারেন!
যেমন, গত ১৮ মে প্রায় এক দশক পর টলিউডে ফিরে এলো ঐতিহ্যবাহী ‘আনন্দলোক’ পুরস্কার। যেখানে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন জয়া আহসান। এর আগে টানা তিনবার সম্মানজনক ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পেয়েও বাঙালিদের মধ্যে রেকর্ড গড়েছেন তিনি। মাদ্রিদ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিদেশি ভাষার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে উপমহাদেশ থেকে একমাত্র জয়া আহসানই পুরস্কার পেয়েছেন। জি সিনে অ্যাওয়ার্ডস, শ্রেষ্ঠ বাঙালির সম্মাননা, বঙ্গ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কারসহ বাংলাদেশে ৪ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ৮ বার মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার, ২ বার বাচসাস পুরস্কারসহ দেশ-বিদেশের এমন অগণিত অর্জন রয়েছে তার ঝুলিতে।
অভিনয় নয়, প্রাণী প্রেমের জন্যেও সম্প্রতি ঢাকার ‘প’ ফাউন্ডেশন থেকে স্বীকৃতি পেয়েছেন জয়া।
তবে ভালো কাজ করেও প্রমোশন বা ইনক্রিমেন্ট না পেলে যেমন হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন অনেকেই, জয়া আহসান পুরস্কার না পেলে মুষড়ে পড়েন না। তার মতে, ‘যা পেয়েছি, সেগুলোই তো যোগ্যতার তুলনায় অনেক বেশি। হয়তো আমার ভাগ্য ভালো; নইলে আমি এত পুরস্কার পাবার যোগ্যই না।’
বিনয়ের সুর কণ্ঠে ধরে রেখে জয়া স্বীকার করেন, ‘‘বিদেশের মাটিতে যখন সম্মান পাই, তখন অবশ্য প্রচ্ছন্নভাবে খুব আবেগী হয়ে পড়ি। কারণ, তখন ব্যক্তি ‘আমি’কে ছাপিয়ে বাংলাদেশের নামটি বড় হয়ে ওঠে।’’
একবার এক আলোচনায় ভারতের জনপ্রিয় নির্মাতা শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, জয়া আহসান এমন একজন, যিনি লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে একসাথে তুলে আনতে পারেন পর্দায়। শিবপ্রসাদের কথা যে ভুল নয়, তার প্রমাণ জয়া বহুবার দিয়েছেন ঢালিউড আর টলিউডে। তার অধিকাংশ সিনেমাই ব্যবসায়িক মানদণ্ডে সফল, একই সাথে সমালোচকদের কাছে প্রশংসিত। কিন্তু অন্য একটা দেশ বা নতুন ইন্ডাস্ট্রিতে গিয়ে নিজের নাম প্রতিষ্ঠা করার রাস্তাটা অত প্রশস্ত ছিল না। শুধু ধৈর্য ও অধ্যবসায় জয়াকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
৯ বছর আগে ৬৬তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের স্মৃতি স্মরণ করে জয়া আহসান বলেন, ‘সেবার আমাকে খোদ আয়োজক কমিটি থেকে অফিসিয়ালি আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। রেড কার্পেটে হেঁটে বেড়ানো থেকে শুরু করে উৎসবের নানা আয়োজনে অংশ নিয়েছিলাম। তখন দেখেছিলাম, বাংলাদেশের সিনেমা সম্পর্কে জানা তো দূরের কথা, আমার দেশের নামটিও অনেকে জানতেন না। অনেকেই আমাকে দেখে প্রশ্ন করতেন, তুমি কি ভারতীয়? বাংলাদেশ সম্পর্কে যাদের ধারণা ছিল, তারা বাংলাদেশকে দেখতেন দুঃখ-দুর্দশা-দুর্ভিক্ষের দেশ হিসেবে। ভালো লাগছে, এখন আমাদের সে অবস্থার কিছুটা হলেও উত্তরণ হয়েছে।’
যদিও মনের মতো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের প্রস্তাব এলে জয়া কাজ করতে চান, যার প্রমাণ ইরানি পরিচালক মুর্তজা অতাশ জমজমের ইরানি চলচ্চিত্র ‘ফেরেশতে’র কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে জয়ার যুক্তি, ‘‘আমি ইংরেজি-বাংলা-হিন্দি বুঝি না। আমি বুঝি অভিনয়। যেকোনও দেশের, যেকোনও ভাষার চলচ্চিত্রে ভালো চরিত্রে কাজ করার জন্য আমি মুখিয়ে থাকি। তবে প্রথম পছন্দ অবশ্যই বাংলা। বাংলা ভাষাতেই ‘এ’ ক্যাটাগরির এমন সব কাজ করতে চাই, যাতে বিশ্ব চলচ্চিত্রের মানচিত্রে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি।’’
জয়া আহসানের হাতে এ মুহূর্তে ক’টি চলচ্চিত্র রয়েছে? প্রশ্ন শুনে হিসাব করতে বসে যান তিনি। সংখ্যাটা যে এক ডজন; নিজেও আগে ভাবতে পারেননি। ১২টি দুর্দান্ত চলচ্চিত্রে জয়াকে সামনে দেখা যাবে, এটা তার ভক্তদের জন্য অবশ্যই অনেক বড় ভালো খবর। শিগগিরই ওপার বাংলায় মুক্তি পাবে ‘ঝরা পালক’। এরপর ‘ওসিডি’, ‘অর্ধাঙ্গিনী’, ‘ভূতপরী’, ‘কালান্তর’, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’। ইরানি চলচ্চিত্র ‘ফেরেশতে’ তো আছেই।
বাংলাদেশে শিগগিরই শুটিং শুরু করছেন সরকারি অনুদান পাওয়া চলচ্চিত্র ‘রইদ’-এর। মুক্তি পাবে ‘বিউটি সার্কাস’, ‘পেয়ারার সুবাস’, ‘নকশী কাঁথার জমিন’ এবং পিপলু আর খানের নাম চূড়ান্ত না হওয়া একটি চলচ্চিত্র। শেষ চলচ্চিত্রটি এবং ‘রইদ’-এর অন্যতম প্রযোজক হিসেবে থাকছে জয়ার প্রযোজনা সংস্থা ‘সি-তে সিনেমা’।
এই একান্ত আলাপের শেষটাতে প্রশ্ন ছিল- জয়া আহসান আর কাদের সাথে কাজ করতে চান? জবাবে বেশ সচেতন এবং সুদূরপ্রসারী এই অভিনেত্রী বললেন, ‘‘আমি নতুনদের সাথে কাজ করতে চাই। যারা নতুনভাবে ভাবে তাদের কাজ করতে চাই। যারা আমাকে বৃত্তের বাইরের কিছু শোনাবে, আমাকে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দেবে, যাদের প্রস্তাব শোনামাত্রই এক বাক্যে ‘হ্যাঁ’ বলতে বাধ্য হবো- এমন আত্মবিশ্বাস নিয়ে যারা আমাকে প্রস্তাব করবেন, তাদের সাথে কাজ করতে চাই।’’