‘হাওয়া’ বিতর্কের দায় সেন্সরবোর্ড এড়াতে পারে?

‘হাওয়া’ যখন টানা চার সপ্তাহ ধরে দেশের অর্ধশতাধিক হলে প্রায় হাউসফুল চলছে, তখন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর ডাক পেলেন পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন! তার বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছে। 

বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের অভিযোগ, সিনেমায় একটি শালিক পাখির সঙ্গে নির্মাতা ‘সঠিক’ আচরণ করেননি।

এরপরই প্রশ্ন উঠেছে, সেন্সরবোর্ডের অনুমতি নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে যাওয়া একটি সিনেমার দায় এককভাবে পরিচালকের কাঁধে কেন বর্তাবে? সিনেমা মুক্তির চূড়ান্ত অনুমোদন দেন যে বোর্ড সদস্যরা, তারা এর দায় এড়াবেন কেমন করে!

বিশ্লেষকরা বলছেন, এর দায় সেন্সরবোর্ড এড়াতে পারে না। তারা যেহেতু পরিবেশনের উপযোগী হিসেবে চলচ্চিত্রটিকে অনুমোদন দিয়েছেন, সেহেতু এখন তাদের পরিচালকের পাশে দাঁড়াতে হবে। আর আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘হাওয়া’ সিনেমার এই দৃশ্যকে অপরাধ জ্ঞান করার আইনগত উপাদান নেই। ছবিতে আসলে দেখানো হয়েছে নৌকায় সব খাবার যখন শেষ হয়ে গেছে, আর একজন মানুষ শুধু বেঁচে আছেন, সেক্ষেত্রে কমন ল ডকট্রিন ‘জাস নেসেসিটিটাস’ অনুযায়ী পাখি হত্যা আইনসম্মত হবে।

‘হাওয়া’র একটি দৃশ্যে চঞ্চল চৌধুরী১৭ আগস্ট ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বন অধিদফতরের পরিদর্শক নারগিস সুলতানা বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। অভিযোগ, ‘হাওয়া’র একাধিক দৃশ্যে পাখিকে খাঁচাবন্দি করে রাখার দৃশ্য রয়েছে। এছাড়া ছবিটির প্রধান চরিত্র চাঁনমাঝি পাখির মাংস খাচ্ছেন দেখানো হয়েছে। মামলায় নির্মাতা সুমনের কাছে ২০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছে। তবে আদালত মামলাটির বিষয়ে এখনও কোনও আদেশ দেয়নি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘পরিচালকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ টেকার সম্ভাবনা খুবই কম। শুটিংয়ে একটা শালিক পাখি সত্যিকার অর্থেই খাঁচাবন্দি ছিল, অনেকদিনই ছিল। তবে শালিকটিকে সত্যিই জবাই করা হয়েছে কিনা তা একটি ঘটনাগত প্রশ্ন (question of fact)। সিনেমার পরিচালক সুমন বলছেন, শালিকটিকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। জাহাজে পাখিটির ফিরে আসার দৃশ্য ফিকশন ছিল। পরিচালক ছবির শুরুতে একটা সতর্কীতে (disclaimer) বলে দিয়েছেন যে, এই ছবিতে কোনও প্রাণীর ক্ষতি করা হয়নি। যেহেতু পাখিটিকে হত্যা করার দৃশ্য ছবিতে দেখানো হয়নি এবং এই সতর্কীর প্রেক্ষিতে ধরে নিই যে, পাখিটিকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘‘আইন বিজ্ঞানে একজনের কাছে একটা জিনিস থাকাটাই ‘দখল’ নয়। দখলে বস্তুর ওপর শারীরিক নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়ন্ত্রণে রাখার মানসিক ইচ্ছে থাকতে হয়। যেহেতু এখানে ‘হাওয়া’র কুশীলবদের পাখিটির কোনও ক্ষতি না করে ছেড়ে দেবার ইচ্ছে প্রতীয়মান, তাই দখল-এর যে আইনগত উপাদান তার উপস্থিতি নেই।’’

ছাড়পত্র দেওয়ার সময় সেন্সরবোর্ড এই দৃশ্য নিয়ে কোনও পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলো কিনা প্রশ্নে পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তারা অনুমোদন দেওয়ার সময় কোনও অবজারভেশন দেয়নি। মামলার পরে কয়দিন আগে তারা জানতে চেয়েছেন, বন্যপ্রাণী অধিকার বিষয়ে কোনও ডিসক্লেমার দেওয়া ছিলো কিনা। আমি তাদের জানিয়েছি, সিনেমার শুরুতে ঘোষণা দেওয়া ছিলো যে এই সিনেমায় কোনও বন্যপ্রাণীর ক্ষতি করা হয়নি। এবং সেন্সরবোর্ডে জমা দেওয়া কপিই হলগুলোকে সরবরাহ করা হয়েছে। যেহেতু সিনেমাটি তাদের অনুমতি নেওয়া ফলে তারা বিষয়টি দেখবেন জানিয়েছেন।’

সেন্সরবোর্ডের একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘‘পাখির দৃশ্যটা সিনেমার প্রয়োজনে ‘সঠিক’ মনে হওয়ায় ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের আইনে যে কেউ মামলা করতে পারে। যারা মামলা করেছেন তারা বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। এখানে ডিসক্লেমার দেওয়া ছিলো যে- সিনেমায় কোনও বন্যপ্রাণীর ক্ষতি করা হয়নি।’’  

‘হাওয়া’র একটি দৃশ্যে শরিফুল রাজসংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার মনে করেন, এই ধরনের মামলা ভালো চলচ্চিত্র তৈরির পথকে রোধ করবে। তিনি বলেন, ‘যেহেতু সেন্সরবোর্ডের অনুমতি নিয়ে সিনেমা হলে গেছে। তাহলে নতুন করে পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা কেন? যে যে পথ ধরে তার চলার কথা সেটা মেনেই তো তিনি এগিয়েছেন।’ 

উষ্মা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘ভালো কাজ এভাবে রুদ্ধ করা ঠিক না। এর বাইরে এতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে, সেসবে নজর দেয়ার কেউ নেই।’

‘হাওয়া’ মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। এতে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী, শরিফুল রাজ, নাজিফা তুষি, সোহেল মণ্ডল, নাসির উদ্দিন খান প্রমুখ।