‘পাঠান’ ছবির বিনিময়ে ভারতে যাচ্ছে কী, চলছে লুকোচুরি!

এমন ঘটনা নতুন নয়। সাফটা চুক্তির আওতায় দুই বাংলায় এমনটা বহুবার ঘটেছে। দেখা গেছে টলিউডের নতুন ও আলোচিত ছবির বিনিময়ে ঢালিউড থেকে টলিউডে রফতানি করা হলো কয়েক বছরের পুরনো ও ফ্লপ ছবি। সেই ছবিটি দেশটির আদৌ কোনও হলে চলেছে কি না, সেই তথ্যটিও স্পষ্ট ছিলো না। অনেকটা এসব কারণেই সেই বিনিময় প্রথায় ভাটা পড়েছে।

এবার শুরু হলো হিন্দি ছবি আমদানি-রফতানি প্রক্রিয়া। চলচ্চিত্রের একাংশের অনুরোধে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্প্রতি বলিউড তথা সাফটা-ভুক্ত ৭ দেশের সিনেমার জন্য খুলে দিয়েছে দেশের বাজার। তবে এ ক্ষেত্রেও দারুণ শর্ত বেঁধে দিয়েছে মন্ত্রণালয়। বলা হয়েছে, বছরে ১০টির বেশি হিন্দি বা এই অঞ্চলের ভিন্ন ভাষার ছবি আমদানি করা যাবে না। এবং যে ছবিটি আমদানি করা হবে তার বিপরীতে বাংলাদেশের একটি ছবি রফতানি করতে হবে।

শর্ত হিসেবে দারুণ। কিন্তু সেই শর্তের ফাঁকে এবারও চলছে শুভঙ্করের ভয়ংকর ফাঁকি। এরমধ্যে সবাই জানেন ‘পাঠান’ ছবিটি আনকাট ছাড়পত্র পেয়েছে সেন্সর বোর্ড থেকে। মুক্তির তারিখ চূড়ান্ত হয়েছে ১২ মে। আমদানিকারক অনন্য মামুন জানান, শনিবার (৬ মে) দুপুর নাগাদ ৩৪টি হল চূড়ান্ত করেছেন তিনি। এটি বাড়বে আরও, ছুঁয়ে দেবে ৫০ হল। এটুকুও জানান, ‘পাঠান’ নেওয়ার জন্য আগ্রহী দেশের শতাধিক হল, কিন্তু প্রথম সপ্তাহে ৫০ হলের বেশি আগাতে চান না।

অর্থাৎ লম্বা যুদ্ধের পর দেশের প্রেক্ষাগৃহে রাজকীয়ভাবে ঢুকছে বলিউড; যাতে আর কোনও অনিশ্চয়তা নাই। এ নিয়ে চলছে সাজসাজ রব। কিন্তু ‘পাঠান’র বিনিময়ে কোন ছবিটি যাচ্ছে বলিউড তথা ভারতে? এই বিষয়টি যেন একেবারেই মাঠে মরে পড়ে আছে। কারও কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। বিষয়টি এমন দাঁড়ালো, দেশের থিয়েটারে বলিউড বাদশাহ ঢুকছেন, তাতেই ধন্য ধন্য!

তাই সরাসরি ‘পাঠান’ আমদানি কর্তার (আমদানি কারক অনন্য মামুন) কাছে প্রশ্ন ছিলো, বিনিময়ে বলিউড পাঠাচ্ছেন কোন ছবি? কণ্ঠে আবদারের অনুরোধ, ‘দেখুন ভাই এতো বড় একটা কাজ করছি। আগে প্রপারলি শুরু করতে দিন।’

‘পাঠান’ গান:

বোঝাতে চাইলেন, ‘পাঠান’ দেশে ঢুকিয়ে বড় একটা বিপ্লব ঘটিয়েছেন এই নির্মাতা-প্রযোজক। যে ছবির মাধ্যমে ‘ধন্য’ হবে দেশ! ফলে এখনই ছোট-খাটো বিষয়ে আলাপ করে যাত্রাভঙ্গ করা ঠিক নয়!

তা না হলে চলচ্চিত্রের সবগুলো সংগঠন মিলে টানা দাবি জানিয়ে কেন তথ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এই আইন অনুমোদন করিয়ে নেবে। অনেকেই বলছেন, এতে করে দেশের হলগুলো অন্তত বাঁচবে। দেশের নির্মাতা-শিল্পীরা এসব ছবি দেখে কিছু শিখবে। বিপরীতে এটুকু ভাববার লোক আর ঢালিউডে অবশিষ্ট নেই, ‘পাঠান’ শিক্ষার বিপরীতে দেশের কোন ছবিটি যাচ্ছে ভারতে, এতিম ঢালিউডকে জানান দিতে। যেটি যাচ্ছে সেটি আদৌ সে দেশে প্রদর্শনযোগ্য ছবি তো? কিংবা সেই ছবি দিয়ে ভারতীয়দের কাছে ঢালিউডের মান আদৌ রক্ষা হবে কি?

অনেকটা এসব তথ্য বা প্রশ্নের জবাব খুঁজতে বাংলা ট্রিবিউন শনিবার (৬ মে) দিনভর যোগাযোগ করে অনেকের সঙ্গে। যোগাযোগ হয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মীর আকরাম উদ্দীন আহম্মদের সঙ্গে। শুরুতেই জিজ্ঞাসা ছিলো ‘পাঠান’ ছবির বিপরীতে কী যাচ্ছে ভারতে? তিনি বলেন, ‘খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তবে এ সম্পর্কে আমার চেয়ে ভালো বলতে পারবেন মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র শাখা। কারণ, সেখান থেকেই এই বিষয়গুলোর চিঠি ইস্যু হয়।’

এরপর যোগাযোগ করা হয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র শাখার ডেপুটি সেক্রেটারি (চলচ্চিত্র-১) সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। ঘণ্টা বাজলেও ফোন ধরেননি। প্রতিবেদকের পরিচয় দিয়ে ক্ষুদেবার্তা দেওয়া হলো। ফোন ব্যাক হয়নি। পরে সেই ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

ফের যোগাযোগ করা হয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে। জানানো হয়, চলচ্চিত্র শাখা থেকে ফোন না ধরার বিষয়টি। তিনি বললেন, ‘আমি খুবই দুঃখিত। এই ফাইলটি আসলে চলচ্চিত্র শাখার আওতায়। ফলে এ সম্পর্কে মাননীয় মন্ত্রী বা সচিব বা আমি- আমরা কেউ ফাইলটা না দেখে বলতে পারবো না, ঠিক কোন ছবিটি যাচ্ছে। তবে আমি চেষ্টা করছি আপনাকে সহযোগিতার।’

‘পাঠান’ ও ‘পাংকু জামাই’ আমদানি-রফতানিকারক অনন্য মামুন

এরপর এই কর্মকর্তা পরামর্শ দিলেন বাংলাদেশ হল মালিক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের। তার নতুন মন্তব্য শোনার আগে বলা দরকার কে এই সুদীপ্ত সরকার? তিনি সে-ই, যিনি গত মার্চে হিন্দি সিনেমা আমদানি নীতিতে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতায় ক্ষোভ জানিয়েছেন সংবাদ সম্মেলন করে। জোরকণ্ঠে বলেছেন, ‘এমতাবস্থায় সিনেমা হল চালু রাখার আর কোনও বাস্তব যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না বিধায় বন্ধ করে দেওয়াই শ্রেয় বলে মনে করি।’

সরকারের বিরুদ্ধে তার এমন কড়া শাসনের ফলাফল তো জাতি এখন দেখছেই। এক মাসের মাথায় মুক্তি পাচ্ছে ‘পাঠান’। এবার বাংলা ট্রিবিউন সুদীপ্ত কুমারের কাছে জানতে চেয়েছে, ‘পাঠান’র বিপরীতে দেশের কোন ছবিটি যাচ্ছে ভারতে। না, বাংলাদেশের এই হল-সরকার মন্ত্রণালয় কর্তাদের মতো ডিপ্লোম্যাটিক হননি। আমদানিকারক অনন্য মামুনের মতো লুকোছাপার অনুরোধও করেননি। বরং সবকিছুই বলে দিলেন স্পষ্ট, ‘‘পাঠান’ ছবির বিপরীতে যেটা যাচ্ছে, সেটা তো অনেক আগেই চইলা গেছে। সেটা হলো ‘পাংকু জামাই’। এটা তখন অনন্য মামুনই এক্সপোর্ট করছিলো।’’

কিন্তু অনেক আগে মানে! ‘পাঠান’ তো এলো মাত্রই। সাফটা আইনও পাশ হলো মাত্রই। জবাবে সুদীপ্ত কুমার বললেন, ‘‘পাংকু জামাই’ এক্সপোর্ট হইছে অনেক আগে। সম্ভবত ৫/৬ মাস আগে।’’

এই ফাঁকে বলে রাখা ভালো, ‘পাংকু জামাই’ শাকিব খান-অপু বিশ্বাস জুটির সফল ক্যারিয়ারের অন্যতম ফ্লপ ছবি। আবদুল মান্নান নামে একজনের পরিচালনায় ছবিটি মুক্তি পায় ২০১৮ সালের ১৬ জুন। সূত্র বলছে ছবিটি ছয় মাস আগে নয়, ভারতে রফতানি হয়েছে ২০১৯ সালে। এবং একই ছবির বিপরীতে দেশে এসেছে আরও ভারতীয় ছবি! যদিও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

ফেরা যাক হল মালিক উপদেষ্টার আলাপে। প্রশ্ন ছিলো, ‘পাংকু জামাই’ কি ভারতে মুক্তি পেয়েছিলো? নাকি ‘পাঠান’র অপেক্ষায় এখনও আটকে আছে! বললেন, ‘আমি তো জানি না ভাই।’

এরপরই প্রশ্ন ছিলো, বলিউডের ব্লকবাস্টার নতুন ছবি ‘পাঠান’। এই ছবিটিকে আনতে বা হিন্দি ছবি দেশে আনার জন্য যুদ্ধ অনেক করেছেন সবাই। অবশেষে সেটি এলো। তো সেই ছবিটির বিপরীতে দেশের নতুন কোনও ভালো ছবি কি ভারতে পাঠানো যেতো না? কেন এমনটা হলো। এক কথায় কেয়ারলেস জবাব, ‘যাবে এখন। মাত্র তো শুরু হইলো।’‘পাংকু জামাই’ দৃশ্যে শাকিব ও অপু

ফের প্রশ্ন, যাবে আর কখন? শুরুতেই তো গলদ। এবার গলা ছাড়লেন এই হল-নেতা। বললেন, ‘‘না না। শুরুতে কিভাবে যাবে। আপনারা তো বাস্তবতার নিরিখে কথা বলেন না। ‘পাঠান’ ছবিটা যে সরকার দেবে, সেটা তো আমরা কেউ নিশ্চিত ছিলাম না। আমরা প্রস্তুত নিচ্ছিলাম আদালতে যাওয়ার। পরে অনেক তদবির করে মন্ত্রণালয় রাজি হলো।’’

এই নেতার আলাপে এটুকু স্পষ্ট, ‘পাঠান’ আমদানিতে অনিশ্চয়তা ছিলো বলেই সংশ্লিষ্ট উৎসাহীরা দেশের ভালো ছবি রফতানির কথা ভাবতে পারেনি! যদিও এমন নজির আগেও দেখা যায়নি টলিউডের ক্ষেত্রে। ফলে পুরনো রফতানি ফাইল থেকে ‘পাংকু জামাই’ এর কাগজ বের করে ‘পাঠান’ আমদানিকে বৈধ করেছে আমদানিকারক অ্যাকশন কাট এন্টারটেইনমেন্ট! এটি যেমন স্বীকার করেছেন সুদীপ্ত কুমার, তেমনি আরও একটি তথ্য দিলেন, দেশের ‘ভালো ছবি’ নাকি ভারতে ভালো চলে না! উদাহরণ হিসেবে টানলেন ‘হাওয়া’।

বলে রাখা দরকার, দেশের সর্বশেষ ব্লকবাস্টার ছবি ‘হাওয়া’ গত ১৬ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের ৩৪টি সিনেমা হলে মুক্তি পায়। এরপর সিনেমাটি ৩০ ডিসেম্বর ভারতজুড়ে মুক্তি পেয়েছে। এটাও সত্যি, বাণিজ্যিক বিচারে ‘হাওয়া’ দেশ মাত করলেও ভারতে সুবিধে করতে পারেনি।

মূলত সেই নজির টেনেই হল মালিক উপদেষ্টা বলেন, ‘ছবিটি যখন ফেস্টিভালে গেছে তখন দেখা যায় লাইন ধরেছে। পরে যখন এক্সপোর্ট হলো, তখন আর হলে মানুষ নাই! এটার মূল কারণ, আমাদের টিভি চ্যানেল ভারতে দেখা যায় না। ফলে আমাদের নায়ক-নায়িকাদের সম্পর্কে ভারতের মানুষ কোনও আগ্রহবোধ করে না।’

‘পাংকু জামাই’-এর গান:

তার মানে এই দাঁড়ালো, যেহেতু ভারতীয়দের কাছে ঢালিউডের সিনেমা নিয়ে আগ্রহ নেই, সেহেতু যে কোনও একটা ছবি এক্সপোর্ট করে নিয়মরক্ষা হলেই হলো। সেটির মান কেমন, আদৌ মুক্তি পেলো কি না- এসব দেখার কেউ নেই-কিছু নেই! মূলত সেই চর্চা বা অবহেলার সূত্র ধরেই ‘পাঠান’-এর মতো বিশ্বহিট সিনেমা বাংলাদেশে ঢুকলো ফ্লপ সিনেমা ‘পাংকু জামাই’-এর রফতানিপত্র দেখিয়ে! যে ছবিটি আদৌ ভারতের কোনও হলে মুক্তি পেলো কি না, কেউ জানে না।

অজানা কারণে সংশ্লিষ্ট অন্য কেউ এ বিষয়ে মুখ না ফোটালেও বাংলাদেশ হল মালিক সমিতির উপদেষ্টা অনেকটা বিরক্ত হয়েই শেষে বললেন, ‘‘পাংকু জামাই’ তো ‘পাঠান’ আমদানির জন্য এক্সপোর্ট হয়নাই। মামুন (অনন্য মামুন) এটা এক্সপোর্ট করেছে কলকাতার কোনও একটা সিনেমা আনার জন্য। ‘পাঠান’ যে অনুমতি পেয়ে যাবে, সেটা তো আমরা ভাবিনাই!’’

এরপর এ বিষয়ে আরেকটু আলাপের আশায় বাংলা ট্রিবিউন যোগাযোগ করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সরবোর্ডের সদস্য ও প্রযোজক নেতা খোরশেদ আলম খসরুর সঙ্গে। না, তিনিও সাড়া দেননি।

বলা প্রয়োজন, বহু বছর দেশে হিন্দি ছবি তথা সাফটাভুক্ত সাত দেশের ছবি আমদানি বন্ধ ছিল। তবে নির্মাতা ও পরিবেশক অনন্য মামুনের আবেদনের প্রেক্ষিতে ফের বিষয়টি নিয়ে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সংগঠন, তথ্য মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দফায় দফায় বৈঠক হয়। এবং সবশেষে গত ১১ এপ্রিল সরকার ঘোষণা দেয় যে, আগামী দুই বছরে উপমহাদেশের ২০টি ছবি আমদানি করা যাবে। তবে মানতে হবে কয়েকটি শর্ত। এর মধ্যে একটি হলো- সিনেমা বিনিময় এবং আমদানিকৃত ছবি ঈদ ও দুর্গাপূজায় মুক্তি দেওয়া যাবে না।

এসব শর্ত মেনেই ১২ মে মুক্তি পাচ্ছে এক হাজার ৫০ কোটি রুপি আয় করা ‘পাঠান’ ছবিটি। এটি বিশ্বের শতাধিক দেশে মুক্তি পায় ২৫ জানুয়ারি।চলচ্চিত্র হল মালিক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস