শিল্পে একুশ: নাটকে ও গানে সমৃদ্ধ, সিনেমায় হাহাকার!

একটি জাতি বা দেশের অস্তিত্বের মূলে রয়েছে ভাষা। এই ভাষাকে ঘিরেই আবর্তিত হয় সেই জাতির শিল্প, সংস্কৃতি, সমাজ যাবতীয় কিছু। আর বাঙালির কাছে তার ভাষা কতখানি গৌরবের, তা তো নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া বিরল জাতি বাঙালি। যেটার স্বীকৃতি দিয়েছে গোটা বিশ্ব।

সেই ভাষার দিন, ভাষা শহীদদের দিন আজ। ১৯৫২ সালের এই দিনে (২১ ফেব্রুয়ারি) রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে নেমে পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন অনেকে। সেই রক্তঝরা ফাল্গুনের ধারাবাহিকতায় জেগেছে বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়েছে নতুন দেশ।

যেই ভাষা থেকে শিল্প-সংস্কৃতির সূচনা, সেই ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট কতখানি উঠে এসেছে শিল্পমাধ্যমে? এর উত্তরে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই পাওয়া যাবে না। কারণ এক এক করে সাতটি দশক পেরিয়ে গেলেও ভাষা আন্দোলন নিয়ে দেশে সিনেমা হয়েছে মোটে তিনটি! এগুলো হলো ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘বাঙলা’ ও ‘ফাগুন হাওয়ায়’। এর মধ্যে প্রথম দুটি সিনেমায় ভাষা আন্দোলন সেভাবে উঠেও আসেনি। আর তৃতীয় ছবির মূল ভিত ভাষা আন্দোলন হলেও এটি দর্শক মহলে সাড়া জাগাতে পারেনি।

‘জীবন থেকে নেয়া’ নির্মাণ করেছিলেন জহির রায়হান। এর গল্প মূলত গণঅভ্যুত্থান ঘিরে। পাশাপাশি নানা রূপকে উঠে আসে ৫২’র প্রেক্ষাপট। এতে অভিনয় করেছিলেন রাজ্জাক, সুচন্দা, আনোয়ার হোসেন, শওকত আকবর, রোজী সামাদ, খান আতাউর রহমান, রওশন জামিলসহ অনেকে। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭০ সালে। 

‘বাঙলা’ ছবিটি পর্দায় আসে ২০০৬ সালে। আহমদ ছফা রচিত উপন্যাস ‘ওঙ্কার’ অবলম্বনে এটি নির্মাণ করেছিলেন শহীদুল ইসলাম খোকন। ছবিতে অভিনয় করেন শাবনূর, মাহফুজ আহমেদ, হুমায়ুন ফরীদি প্রমুখ।

সবশেষ ছবি হিসেবে ‘ফাগুন হাওয়ায়’ মুক্তি পায় ২০১৯ সালে। তৌকীর আহমেদ নির্মিত এই ছবির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সিয়াম আহমেদ, নুসরাত ইমরোজ তিশা, যশপাল শর্মা (ভারত), আবুল হায়াত, ফজলুর রহমান বাবু, হাসান আহমেদ প্রমুখ।

লম্বা বিরতির পর দেশভাগ ও ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে ২০২২ সালে নির্মিত হয়েছে আরেকটি ছবি। ‘যাপিত জীবন’ নামের এই ছবিটি নির্মাণ করছেন হাবিবুল ইসলাম হাবিব। যার প্রধান চরিত্রে আছেন আফজাল হোসেন। ছবিটির অন্যতম অভিনেত্রী ও নির্মাতার কন্যা আশনা হাবিব ভাবনা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ছবিটির শুটিং, ডাবিং ও সম্পাদনা শেষ অনেক আগেই। আটকে আছি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক নিয়ে। এটি একবার একজনকে দিয়ে করা হলেও পছন্দ হয়নি আব্বুর (হাবিবুল ইসলাম হাবিব)। এখন আবার সেটি ইমন সাহা দাদাকে দেওয়া হয়েছে। অনেক কষ্ট করে ছবিটা আমরা তৈরি করছি। আশা করছি এ বছরই মুক্তি দিতে পারবো।’‘যাপিত জীবন’ সিনেমায় আশনা হাবিব ভাবনা/ ছবি: মাহমুদ মানজুর

ভাষা নিয়ে সিনেমার ইতিহাস এমন হাহাকারে ডুবে আছে কেন?

ঢালিউডের অন্যতম নেতা ও নির্মাতা মুশফিকুর রহমান গুলজার মনে করেন, ‘এ ধরনের ঐতিহাসিক বিষয়কে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। এজন্য বিস্তর গবেষণা দরকার। প্রচুর অর্থলগ্নির বিষয় আছে। মূলত এসব কারণেই ভাষা নিয়ে ছবি হচ্ছে না। এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ জরুরি। আমার কথা হচ্ছে, সরকার তো প্রতি বছরই কোটি কোটি টাকা অনুদান দিচ্ছে সিনেমার জন্য। সেখানে ভাষা নিয়ে সিনেমা নির্মাণের জন্য আলাদা বাজেট রাখা দরকার বলে মনে করি। অনুদান কমিটিতে যারা থাকেন, তারা প্রত্যেকেই অত্যন্ত বিজ্ঞ মানুষ। তাদের মাধ্যমেই ভাষা আন্দোলন নিয়ে বছরে অন্তত একটি করে ছবি অনুদান পেতে পারে। সেটা তো হচ্ছে না। সময় এসেছে এক্ষেত্রে সরকারের একটু নজর দেওয়ার।’

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে সিনেমা অঙ্গনে বিরাট খাদ থাকলেও নাটকে আর গানে তা কিছুটা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা রয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগেই। গত সাত দশকে মাতৃভাষা নিয়ে বহু গান হয়েছে, প্রতি বছরই নিয়ম করে নির্মিত হচ্ছে বেশ কিছু বিশেষ টিভি নাটক, মঞ্চেও রয়েছে ভাষা নিয়ে সমৃদ্ধ অনেক নাটক। তবে সব ছাপিয়ে ভাষার গানই বাংলাদেশের ইতিহাসে মোটামুটি স্বস্তি দেয়।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রথম রচিত গান ‘ভুলবো না, ভুলবো না, একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলবো না’। ১৯৫২ সালে এটি লিখেছিলেন ভাষাসৈনিক গাজীউল হক। এর সুর করেছিলেন নিজাম উল হক। পরের বছর (১৯৫৩) ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিলো’ শিরোনামে একটি গান রচনা করেন ভাষাসৈনিক মোশারেফ উদ্দিন আহমদ। এতে সুর দিয়েছিলেন আলতাফ মাহমুদ। এটিকে বলা হয় প্রভাতফেরির প্রথম গান।

তবে একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত যে গান, সেটার রচয়িতা আব্দুল গাফফার চৌধুরী। যদিও এটা প্রথমে ছিল কবিতা। অতঃপর তাতে সুর দেন আব্দুল লতিফ। পরবর্তীতে গানটি পুনরায় সুর করেন আলতাফ মাহমুদ। আর দ্বিতীয় সুরটি ছড়িয়ে যায় দেশজুড়ে, বাতাসের মতো। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি মাতৃভাষা দিবসের প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। 

সুরকার আব্দুল লতিফের লেখা ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ গানটিও কালজয়ের খেতাব পেয়েছে। এছাড়া ভাষা আন্দোলন তথা মাতৃভাষা নিয়ে উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে-  ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ (ফজল-এ-খোদা), ‘অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে’ (আবু হেনা মোস্তফা কামাল), ‘ফসলের মাঠে, মেঘনার তীরে’ (শামসুর রাহমান), ‘একঝাঁক পলাশের দুরন্ত রক্তে’ (ইন্দু সাহা), ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালি’ (শামসুদ্দিন আহমদ), ‘বাংলা আমার মায়ের ভাষা এমন ভাষা আর যে নাই’ (মোহাম্মদ মাতু মিয়া), ‘শোন দেশের ভাই-ভগিনী’, ‘কাইন্দ না মা কাইন্দ না আর বঙ্গজননী’ (হেমাঙ্গ বিশ্বাস) ইত্যাদি।

এখনও প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে নতুন নতুন গান করেন প্রজন্মের সংগীতশিল্পীরা। অর্থাৎ গানের ভুবনে একুশের চর্চা যেমন ছিল, এখনও তেমন আছে।

পাশাপাশি বিভিন্ন টিভি ও মঞ্চ নাটকেও প্রায় প্রতি বছর ভাষার চেতনা উঠে আসে নানা আবহে। ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নে আসকার ইবনে শাইখ লিখেছিলেন নাটক ‘দুর্যোগ’। ভাষা আন্দোলনের যোদ্ধাদের নিয়ে এই স্বনামধন্য নাট্যকার ১৯৫৪ সালে লিখেছিলেন ‘যাত্রা’ নাটকটি। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর মঞ্চ নাটক ‘কবর’ যেন ভাষা আন্দোলনে জীবন উৎসর্গ যোদ্ধাদেরই বীরত্বগাঁথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ‘কবর’ নাটকটি মুনীর চৌধুরী ১৯৫৩ সালে কেন্দ্রীয় কারাগারে রচনা করেন। নাটকটি প্রথম মঞ্চায়ন হয় একই বছর ২১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় কারাগারে।ফেরদৌস হাসান রানা নির্মিত আলোচিত ‘স্বরে অ’ নাটকের একটি দৃশ্যে ইমন ও সুমাইয়া শিমু, প্রচার হয়েছিলো এনটিভিতে