রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদি মহম্মদের মৃত্যু

১৯৬৮ সাল থেকে সাদি ভাইকে দেখছি: ফারুক আহমেদ

দুঃসংবাদটি শুনেই বুধবার (১৩ মার্চ) রাত ১১টা নাগাদ রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের লাশঘরের সামনে হাজির হলেন দেশের অন্যতম অভিনেতা ফারুক আহমেদ। সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন উদাস ও বিষণ্ণ দৃষ্টিতে। সংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদের সঙ্গে অভিনেতার সংযোগ নিয়ে অনেকেই তখন ভাবছিলেন।

জবাবটা মিললো লাশঘরের পাশে দাঁড়িয়ে স্মৃতিকাতর ফারুক আহমেদের বয়ান থেকে। যে বয়ানের দৃশ্যপট এমন, তিনি যখন ক্লাস ফোরের ছাত্র তখন সাদি মহম্মদ পড়েন সপ্তম শ্রেণীতে। দুজনেরই বসবাস একই মহল্লায়। ফারুক আহমেদের বড় ভাইয়ের বন্ধু ও সহপাঠী ছিলেন সাদি মহম্মদ। সে হিসেবে তাদের সম্পর্কটা মহল্লার চেয়েও ঢের বেশি ও পারিবারিক। 

স্মৃতির বাক্স খুলে ফারুক আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বললেন, ‘১৯৬৮ সালে আমার বাবা মোহাম্মদপুর গভর্মেন্ট স্কুলে জয়েন করলেন হোস্টেল সুপারেন্ডিন্ট হিসেবে। আমাদের পরিবার হোস্টেলের কোয়ার্টারে থাকতাম। পাশে ছিলো সাদি ভাইদের বাড়ি। সাদি ভাই আমার বড় ভাইদের সঙ্গে পড়তেন। ওনারা মেট্রিক পাশ করলেন ৭২ সালে। আর সাদি ভাইর ছোট ভাই শিবলি ভাই ৭৪ সালে, আমি পাশ করি ৭৫ সালে। শিবলি ভাইর সাথে আমার বেশি সখ্যতা ছিলো, যেহেতু আমরা পিঠাপিঠি বয়সের। আর বড় ভাইয়ের বন্ধু হিসেবে সাদি ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা ছিলো বেশ পারিবারিক। যেমন আমরা রোজ হোস্টেলের বাসা থেকে বেরিয়ে সাদি ভাইদের বাসার নিচে যেতাম। আড্ডা দিতাম। সবাই মিলে খেলাধুলা করতাম। আমার বড়ভাই আবার গান লিখতেন। দেখতাম তখন সাদি ভাই সুর দিয়ে সেটা গাইতেন। আমাদের বাসায় অথবা স্কুলের ফাঁকা ক্লাসরুমে বসে তারা গান নিয়ে মগ্ন থাকতো।’

থামেন না ফারুক আহমেদ। দম নিয়ে বলতে থাকেন, ‘‘এরপর একটা সময় আমরা মোহাম্মদপুর ছেড়ে চলে গেলাম। যে যার মতো ব্যস্ত হলাম। বছর দুয়েক আগে সাদি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা বিটিভিতে। আমাকে জড়ায়ে ধরে বললেন, ‘তুই এতো বড় হয়ে গেলি! তোকে হাফপ্যান্ট পরা দেখেছি। তুই ভালো অভিনয় করিস। তোকে দেখি টিভিতে’। তখন আমি বললাম, গান শুনতে হলে আমি আপনার গানই শুনি। উনি বললেন, ‘তুই আমাকে ভালোবাসিস বলেই হয়তো শুনিস’।’’

কথা বলছিলেন ফারুক আহমেদঅভিনেতা মনে করেন, শিল্পী সাদি মহম্মদ কতো বড় মাপের ছিলেন; সেটা ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে। তবে তিনি লাশঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিলেন মানুষ সাদি মহম্মদের। তার ভাষায়, ‘আমার জীবনে এমন ভালোমানুষ খুব একটা দেখিনি। এটা আজকে বলে বলছি না। গতকালও যদি কেউ আমাকে ভালোমানুষের নাম জানতে চাইতো, তবে ওনার নাম সবার আগে বলতাম। আমি সেই ৬৮ সাল থেকে ওনাকে দেখি। কোনোদিন কাউকে একটা কটু কথা বলতে শুনিনি। অথবা কারও সঙ্গে রাগ হয়ে কথা বলেছেন বলে দেখিনি। এতো বড় একজন শিল্পী, কোনও অহমিকা ছিলো না। এমন মানুষ এভাবে চলে গেলে আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। আমাদের আসলে ভাষা থাকে না মুখে। উনি এভাবে হুট করে চলে গিয়ে আমাদের বোবা করে দিয়েছেন।’

এদিকে এদিন রাত ১০টার দিকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতলের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. স্বাগতিক লোহানী জানিয়েছেন, শিল্পীর গলায় দাগ পাওয়া গেছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে মোহাম্মদপুর বাড়ির নিজ কক্ষ থেকে তাকে উদ্ধার করেন পরিবারের সদস্যরা। রাত সাড়ে ৯টার দিকে হাসপাতালে আনা হলে মৃত ঘোষণা করা হয়। প্রাথমিক তদন্তে চিকিৎসক ও পুলিশ এটাকে ‘আত্মহত্যা’ বলে নিশ্চিত করেছে। পরিবারের সদস্যরা তাকে নিজ কক্ষে ঝুলন্ত অবস্থায় পেয়েছেন বলেও জানান এই চিকিৎসক।

সাদি মহম্মদের ব্যক্তিগত সহকারি সোহেল মাহমুদ জানান, বুধবার (১৩ মার্চ) সন্ধ্যায় বেগুনি ও মুড়ি দিয়ে ইফতারি শেষে নিজ রুমে যান শিল্পী। বেশ কিছুক্ষণ রেয়াজ করেন তানপুরা দিয়ে। এরপর অনেকসময় চুপচাপ থাকায় রুমে ঢুকতে গিয়ে দেখেন দরজা বন্ধ। ডাকাডাকিতে সাড়া মিলছিলো না। পরে দরজা ভেঙে ঢুকে পরিবারের সদস্যরা দেখেন ঝুলন্ত অবস্থায় শিল্পীর নিথর দেহ।