ক্রমাগত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে সিরিয়াবাসীর মৃত্যুর মিছিল
কয়েক দফার ব্যর্থতার পর অবশেষে অস্ত্রবিরতি
অস্ত্রবিরতি ভেঙে দীর্ঘ করা মৃত্যুর মিছিল আর নিরাপত্তা পরিষদের নিস্ফল বৈঠক
পারস্পরিক দোষারোপ সত্ত্বেও অস্ত্রবিরতি কার্যকর হওয়ার পর আলেপ্পোতে সহিংসতা অনেকাংশেই হ্রাস পায়। তবে গত সপ্তাহে অস্ত্রবিরতির চুক্তি ভেঙে যাওয়ার পর শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) থেকে তা আবার বিস্তৃত হয়। বিদ্রোহী অধ্যূষিত অঞ্চলগুলোতে সরকারি বাহিনীর শনিবারের হামলায় অন্তত ৯১ জন নিহত হওয়ার খবর জানায় কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। রবিবার সকালে (২৫ সেপ্টেম্বর) সিরিয়ান অবজারভেটরি জানিয়েছে, সিরিয়ায় অস্ত্রবিরতি ভেঙ্গে পড়ার পর থেকে আলেপ্পো ও আশেপাশের এলাকায় হামলায় এক সপ্তাহে ২১৩ বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। অবরুদ্ধ হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। ২০ লাখ মানুষ হাহাকার করছেন পানির জন্য। জাতিসংঘের ৭১তম সাধারণ অধিবেশন চলাকালে ২৪ সেপ্টেম্বর সিরিয়ার আলেপ্পো শহরে নতুন করে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় ‘শঙ্কিত’ হয়ে পড়েন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন।
রবিবার নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকের শুরুতে সিরিয়াবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত স্তেফান ডি মিস্তুরা বলেন, ‘আলেপ্পোর উত্তরাঞ্চলে চলমান অভিযানের কারণে সেখানকার দুই লাখ ৭৫ হাজার মানুষ ২০ দিন ধরে কার্যত অবরুদ্ধ রয়েছেন।’ ৯ সেপ্টেম্বরের সমঝোতা অনুযায়ী কাজ করতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াকে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যে সমঝোতা হয়েছে, তা রক্ষা করা না হলে ধীরে ধীরে ওয়াশিংটন ও মস্কোর ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।’ সিরিয়ায় ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা নির্বিঘ্ন করতে প্রতি সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা অস্ত্রবিরতির ব্যবস্থা করার জন্যও নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। তবে পারস্পরিক দোষারোপে নিস্ফল হয়ে যায় নিরাপত্তা পরিষদের সেই বৈঠক।
রুশ-মার্কিন পারস্পরিক দোষারোপের রাজনীতি
জাতিসংঘ অধিবেশন চলাকালেই নিরাপত্তা বৈঠক আহ্বানকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স সিরিয়ায় সরকারি অভিযানকে সমর্থন দেওয়ায় রাশিয়াকে দায়ী করে। সিরিয়ার সরকারি বাহিনীকে সমর্থন দেওয়ার মধ্য দিয়ে রাশিয়া বর্বরতাকে সমর্থন দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন যুক্তরাষ্ট্রের দূত সামান্থা পাওয়ার। তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা যদি এখনও নিশ্চুপ থাকেন, তাহলে ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না।’ পরে সিরিয়া সরকারের প্রতিনিধি বক্তব্য শুরু করার আগেই সিরিয়া সরকারের বোমা হামলার প্রতিবাদে ব্রিটিশ দূত ম্যাথিউ রাইক্রফট, পাওয়ার ও ফরাসি দূত ফ্রাঁসোয়া দেলাত্রি বৈঠক থেকে বের হয়ে যান।
এদিকে, জাতিসংঘে রাইক্রফট এই জরুরি বৈঠকে বলেন, ‘সেনাঘাঁটি ধ্বংস করার মতো বোমা দিয়ে ঘরবাড়ি ও আশ্রয়কেন্দ্র ধ্বংস করা হচ্ছে। এতে প্রচুর প্রাণহানিও ঘটছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণ নাগরিকদের আবাসিক এলাকায় নির্বিচারে ব্যবহৃত হচ্ছে সমরাস্ত্র। আলেপ্পো পুড়ে যাচ্ছে। এবং পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে।’
বিপরীতে জাতিসংঘে রাশিয়ার দূত ভিটালি চুরকিন ওয়াশিংটনকে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে বিরোধীদের প্রভাবিত করতে সমর্থ না হওয়ার জন্য অভিযুক্ত করেন। ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেশকভ আরও বলেন, ‘মস্কো ভয় পাচ্ছে, অস্ত্রবিরতির সুযোগে জঙ্গিরা নিজেদের পুনর্গঠিত করবে ও পরবর্তী আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নেবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জঙ্গিদের সঙ্গে মডারেটদের কোনও পার্থক্য নেই। জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই বন্ধ করা যাবে না।’ পরে ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেশকভ বলেছেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধিদের বাগাড়ম্বরপূর্ণ মন্তব্যকে একেবারেই গ্রহণযোগ্য মনে করছি না। এই মন্তব্য আমাদের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে।’
রক্ত-ধ্বংস আর মৃত্যুই কি ‘খাদের কিনারে দাঁড়ানো’ সিরিয়ার ভবিষ্যত?
সিরিয়াবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত স্তেফান ডি মিস্তুরা নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে ‘খাদের কিনার থেকে’ সিরিয়াকে রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার প্রতি। বৈঠকের পর ক্রেমলিন মুখপাত্র পেশকভ অবশ্য বলেছেন, “সিরিয়ার সাম্প্রতিক অস্ত্রবিরতির ‘যৎসামান্য প্রভাব’ পড়েছে, কিন্তু মস্কো আশাহত নয়, সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিয়ে সিরিয়ায় রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দিকে এগিয়ে যেতে আগ্রহী রাশিয়া।” তবে তার কথায় তেমন কোনও আশা দেখেন না রাজনীতিবিশ্লেষকরা।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-কে নিয়ে ৩০ বছর ধরে গবেষণা করছেন রে ম্যাকগভার্ন নামের এক সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা। সংবাদমাধ্যম কাউন্টার পাঞ্চে লেখা এক নিবন্ধে কিছুদিন আগে তিনি আশঙ্কা করেন, ‘যদি এমন হয় যে, পুতিন-ওবামার চেয়ে বেশি যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনায়ক দুই দেশের ক্ষমতায় আবির্ভূত হয়, তাহলে এই যুদ্ধ পারমাণবিক যুদ্ধে মোড় নেবে।’ এই আশঙ্কা সত্য হলে কোনও পক্ষই যুদ্ধে জিতবে না। জিতবে ধ্বংসযজ্ঞ। আর হারবে মানুষ।
স্পুটনিক নিউজ-এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে ইফগেনি বুসিনস্কাই নামের একজন রুশ রাজনীতিবিশ্লেষক অবশ্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোনও সম্ভাবনা দেখছেন না। ইফগেনির মতে, ‘এসব ঘটনায় পশ্চিমাবিশ্ব একপর্যায়ে সিরিয়ার ওপর বেশি বেশি অবরোধ জারি করবে। এতে কেবল সিরীয়দের মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হবে। ধ্বংস হবে সিরিয়া।’ ইফগেনি আশঙ্কা করছেন, দুই পক্ষের এই পারস্পরিক লড়াই সেখানে চরমপন্থার বিস্তৃতি ঘটাবে। ফরেন পলিসির এক বিশ্লেষণেও একই আশঙ্কার কথা জানানো হয়। ২৩ সেপ্টেম্বরের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সিরিয়া ইস্যুতে রুশ-মার্কিন বিরোধ সেখানকার বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে আল কায়েদা/নুসরা ফ্রন্টের মতো সংগঠনগুলোর যোগাযোগ গড়ে তোলার দিকে আগ্রহী করে তুলবে।
/বিএ/
আপ - /এসএ/