ইন্টারসেপ্ট-এর অনুসন্ধান

ট্রাম্পের কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করার হাতিয়ার হতে যাচ্ছে এফবিআই







nonameসদ্য দায়িত্ব নেওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কর্তৃত্বকে আরও নিরঙ্কুশ করার হাতিয়ার হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। সাড়া জাগানো মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইন্টারসেপ্ট-এর একটি পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদন থেকে এ কথা জানা গেছে। সিআইএ-র কাছে সংগৃহীত এফবিআইয়ের সাম্প্রতিক উন্মোচনকৃত ১ কোটি ৩০ লাখ পৃষ্ঠার নথির বরাত দিয়ে ইন্টারসেপ্ট জানিয়েছে, কথিত সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের নামে দমন প্রক্রিয়া, বর্ণবাদী রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কার্যক্রম এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘনে সহায়ক ভূমিকা রাখার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে যাচ্ছে এফবিআই। এফবিআই ট্রাম্পের নির্বাচন জয়েও সহযোগী ভূমিকা পালন করেছে উল্লেখ করে ইন্টারসেপ্ট তাদের পর্যালোচনামূলক ওই প্রতিবেদনে দাবি করে, ট্রাম্পের জয়ের ফলে এক নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যখন এফবিআইয়ের কাজের পদ্ধতি জানাটা হয়ে পড়েছে আরও বেশি জরুরি।


গত বছর ডিসেম্বরে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, বন্দি নির্যাতনে কুখ্যাতি অর্জন করা গুয়ানতানামো বে কারাগার সহসা বন্ধ করছেন না মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কাছাকাছি সময়ে একইভাবে নিউ ইয়র্ক টাইমসও একইভাবে জানায়, ‘ব্ল্যাক সাইট’ কারাগারগুলোও সহসা বন্ধ হচ্ছে না। সবশেষ এ বছর জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বাক্ষরিত তিন পৃষ্ঠার খসড়া নিরাপত্তা পরিকল্পনা ফাঁস করে প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস। হাতে পাওয়া নথির বরাত দিয়ে পত্রিকাটি জানায়, বুশ যুগে চালু থাকা সিআইএর ভয়াবহ গোপন কারাগার ব্যবস্থা এবং জিজ্ঞাসাবাদের প্রক্রিয়া ফিরিয়ে আনবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।



প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথের দিনের অভিষেক বক্তৃতাতেই ট্রাম্প জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অব্যাহত লড়াইয়ের ঘোষণা দেন। আর ক্ষমতা গ্রহণের পর নির্বাহী আদেশে মুসলিমবিরোধী অভিবাসন নীতি চালু করেন তিনি। বুশ যুগের ধারাবাহিকতায় মুসলিমবিরোধী ভূমিকার নেপথ্যে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করান পুরনো জাতীয় নিরাপত্তার প্রসঙ্গ।
সম্প্রতি উন্মুক্ত হওয়া এই ১ কোটি ৩০ লাখ পৃষ্ঠার গোপন নথি থেকে এফবিআই-র গোপন কার্যপ্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করেছে ইন্টারসেপ্ট। তাদের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে মার্কিন রাজনীতিতে এফবিআই-এর ভূমিকার কথা। আল-জাজিরার ডিসেম্বরের প্রতিবেদন, জানুয়ারির শেষ দিকে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর ফাঁসকৃত ট্রাম্প প্রশাসনের খসড়া পরিকল্পনা, ট্রাম্পের অভিষেক বক্তৃতা এবং তার মুসলিমবিরোধী নির্বাহী আদেশের সঙ্গে ইন্টারসেপ্ট-এর প্রতিবেদনকে মিলিয়ে পড়লে দেখা যায়, ট্রাম্পের কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করার হাতিয়ার হতে যাচ্ছে এফবিআই।

noname
ট্রাম্পের নীতির স্পষ্ট দর্শন হচ্ছে কর্তৃত্বপরায়নতা। তিনি কর্তৃত্বপরায়ণ ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়েছেন। ইন্টারসেপ্ট আশঙ্কা করছে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, জনগণের ব্যাপক বিক্ষোভ দমনে কর্তৃপক্ষ এফবিআইকে কাজে লাগাবে। ট্রাম্প আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকেও আরও কর্তৃত্ব দেবেন। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে জনগণের অধিকার খর্ব করতে এটা করবেন তিনি। সাতটি মুসলিম দেশের নাগরিক ও শরণার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারির মধ্য দিয়ে ট্রাম্প এরই মধ্যে শুরু করে দিয়েছেন।
যেভাবে হাতে এলো এফবিআই-র গোপন নথি
এফবিআইয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া জানতে এবং গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু গোপন নথি প্রকাশের দাবি জানিয়ে নাগরিক আন্দোলনের আইনজীবীরা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন বহুবার। কিন্তু দেশটির বিচারকরা দীর্ঘদিন তা প্রত্যাখ্যান করে গেছেন। অবশেষে জনদাবির মুখে এ বছর জানুয়ারিতে ১ কোটি ৩০ লাখ গোপন নথি অবমুক্ত করতে বাধ্য হয় সিআইএ। আর সেখানে থাকা এফবিআই-সংক্রান্ত নথিগুলো পর্যালাচনা করে প্রতিবেদন ও তা সিরিজ আকারে প্রকাশ করেছে ইন্টারসেপ্ট। তাদের এ চেষ্টা ছিল জনগণের স্বার্থেই।
ট্রাম্প-এফবিআই সখ্য
কিভাবে এফবিআই ট্রাম্প শাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় পরিণত হবে, ইন্টারসেপ্ট-এর প্রতিবেদনে তা উঠে এসেছে। ইন্টারসেপ্ট দাবি করে, সবকিছুর ঊর্ধ্বে ট্রাম্প তার নিজের প্রতি আনুগত্য প্রকাশকে গুরুত্ব দেন। ফলে তার জয়ে যারা ভূমিকা রেখেছেন অথবা প্রেসিডেন্ট হতে বিশেষ অবদান রেখেছেন তাদের তিনি ভুলে যাবেন না এটা নিশ্চিত। আর এফবিআই তো ট্রাম্পের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে সবচেয়ে অস্বাভাবিক ঘটনাই ছিল এটা। এফবিআই অপর মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র সঙ্গেও রাজনৈতিক বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। সিআইএ-র অনেক শীর্ষ কর্মকর্তাই ছিলেন হিলারি ক্লিনটনের সমর্থক। বিপরীতে এফবিআইয়ের অনেকেই ছিলেন ট্রাম্পের কট্টর সমর্থক। নির্বাচনে পরাজয়ের এক সপ্তাহ পরে হিলারি ক্লিনটন নিজেই তার পরাজয়ের জন্য এফবিআই প্রধান জেমস কোমিকে দায়ী করেছেন। এফবিআইয়ের নিউ ইয়র্ক কার্যালয়ের অনেকেই আতঙ্কিত ছিলেন হিলারির বিরুদ্ধে কোমির অভিযোগ না আনার কারণে। এছাড়া ক্লিনটনের তথ্য ফাঁসে রুডি গিলিয়ানির বিষয়টি চাপা দেওয়ার কারণে সংস্থাটির ৩৫ হাজার কর্মী আতঙ্কে ছিলেন। কিন্তু কোমিকে প্রধান হিসেবে রাখার মধ্য দিয়ে তাদেরকে আশ্বস্থ করা হয়েছে, তাদের চাকরি নিশ্চিত হয়েছে। অনেক সরকারি কর্মকর্তা জানান, এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে প্রশাসনে।

noname
জন-অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের বিপরীতে এফবিআইএর দমনপ্রক্রিয়া
১৯৭৬ সালে এফবিআই-র প্রথম প্রধান হোভারের ‘বাড়াবাড়ি’ তদন্তে গঠিত হয়েছিল চার্চ কমিটি। বিশেষ করে কুখ্যাত ‘কোয়েন্টেলপ্রো’ প্রকল্প ছিল তদন্তের কেন্দ্রে। এ কুখ্যাত পরিকল্পনার অধীনে এফবিআই এজেন্টরা টার্গেট করে সরকার ‘হুমকি’ মনে করে এমন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে অনুপ্রবেশ করত। এর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভকারী, কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদী ও নাগরিক অধিকার আন্দোলনের অ্যাক্টিভিস্টরাও। ওই তদন্তের পর এফবিআইয়ের ক্ষমতায় বেশ কিছু সংস্কার আনা হয়।
সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের নামে মার্কিন আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় এফবিআই
ইন্টারসেপ্টসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম পর্যাপ্তভাবে দেখিয়েছে, সন্ত্রাসবাদের যুদ্ধের নামে এফবিআই ‘কোয়েন্টেলপ্রো’- এখনও অনুশীলন করছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একাধিকবার নির্দোষ মুসলিমদের ব্যুরোর নিজেদের লোক দিয়ে মিথ্যা সন্ত্রাসবাদে যুক্ত করা হয়েছে। ইন্টারসেপ্টের প্রকাশিত এসব নথিতে দেখা যায়, কিভাবে এফবিআই নীরবে ৭০ দশকের কেলেঙ্কারির পর নিজেদের কাজের প্রক্রিয়া অক্ষত রেখে নতুন নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের দরজা উন্মুক্ত করছে।
এ বিষয়ে এফবিআইয়ের কাছে জানতে চাইলে সংস্থাটি বিবৃতিতে দাবি করে, এফবিআই আইন মেনেই কাজ করছে। তাদের সব পদ্ধতি সংবিধান, মার্কিন আইন ও অ্যাটর্নি জেনারেলদের নির্দেশনা দ্বারা স্বীকৃত।
বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারসেপ্ট লিখেছে, এফবিআইয়ের কাজের সত্যিকার পদ্ধতি সম্পর্কিত নথির অভাবে সংস্থার উপরোক্ত দাবি অনেকটাই মেনে নেওয়ার মতো মনে হতে পারে। তবে বিচার করে দেখা দরকার, আসলেই এফবিআই কিভাবে এমন অস্বচ্ছ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে। ফলে তাদের নিয়ম ও রীতিগুলো পড়ে দেখা প্রয়োজন, যা এফবিআই গোপন রেখেছে এবং বাইরের কারও পক্ষে তা পাওয়া দুষ্কর। উদাহরণ হিসেবে ইন্টারসেপ্ট তুলে ধরেছে একটি ঘটনার কথা। ব্যুরোর কোনও এজেন্ট কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠনকে বৈধ মনে না করেন, তাহলে ওই সংগঠনের বাকস্বাধীনতা নেই বলে সিদ্ধান্তে উপনীত হয় সংস্থাটি।
noname
তারা কোনও অবৈধ কাজ করছে কিনা তা নিশ্চিত না হয়েই সম্ভাব্য তথ্যদাতার খোঁজ শুরু হয়। আর তা করা হয় কারও অভিবাসন অবস্থাকে কেন্দ্র করে। টার্গেট ব্যক্তিকে চাপে ফেলা হয়। তাদের সহযোগিতা না করলে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর হুমকি দেওয়া হয়। আবার তথ্য উদ্ধার শেষ হয়ে গেলে নিজ দেশে ফেরত যেতে বাধ্যও করা হয়। অথচ ওই ব্যক্তি কোনও অপরাধ করেননি এবং সন্দেহভাজনও নন। এমন আরও হুমকি ও তথ্য আছে তাদের কাছে দাবি করা হয়, যার কোনও এখতিয়ার নেই তাদের। এছাড়া ইন্টারনেটজুড়ে তথ্যদাতা বাহিনী, বিভিন্ন চ্যাটরুমে অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে প্রবেশ করে ব্যুরোর লোকজন।



এফবিআই এজেন্টরা ইন্টারসেপ্ট-এর প্রতিবেদকদের কাছে এসব কর্মকাণ্ডের নানা সাফাই গেয়েছেন। তবে প্রাপ্ত নথি পর্যালোচনা করে নিজেদের তৈরি করা প্রতিবেদনে এফবিআইয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটাই সামনে এনেছে ইন্টারসেপ্ট। নাগরিক অধিকারের পরিসর থেকে ইন্টারসেপ্টের এই ভূমিকা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবি করেছে সংবাদমাধ্যমটি।
বর্ণবাদী পুলিশ বাহিনী
প্রকাশিত নথির বরাত দিয়ে ইন্টারসেপ্টের প্রতিবেদনে দেশটির পুলিশবাহিনী সম্পর্কে এফবিআইয়ের একটি পর্যালোচনার প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। পুলিশ সংক্রান্ত ওই পর্যালোচনাতে এফবিআই নিজেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। নথিতে বলা হয়েছে, দেশটির পুলিশবাহিনীতে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী ও আধিপত্যবাদীদের সঙ্গে প্রকাশ্য সম্পর্ক রয়েছে। পুলিশ তাদের সঙ্গে তথ্যবিনিময় করে।

নিউ ইয়র্ক সিটি পুলিশ
এই তথ্যটি এমন সময় প্রকাশিত হলো যখন যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ ট্রাম্পকে সমর্থন করছে। পুলিশ এমনকী সেই সমর্থন গোপনও করতে চাইছে না। একসময় ট্রাম্প নিজেও একটি প্রচারণা শুরু করেছিলেন। রিপাবলিকান মনোনয়ন পাওয়ার তিনি বল্গাহীন পুলিশবাহিনীকে লাগাম পরানোর কথা বলেছিলেন। আর এখন সেই পুলিশই ট্রাম্পের সবচেয়ে অনুগত। ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া প্রতিষ্ঠার হুমকি দিচ্ছে তারা। যাদের অনেকেই আবার বর্ণবাদী মানসিকতা সম্পন্ন।
হুমকিতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা
এফবিআই-এর নথি পর্যালোচনা করে ইন্টারসেপ্ট আরও লিখেছে, ট্রাম্প যুগে আমরা এমন একটা সময়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছি যখন যুক্তরাষ্ট্র সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সমালোচক ব্যক্তিই দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল মনোনীত হয়েছেন। ক্ষমতায় রয়েছেন এমন একজন প্রেসিডেন্ট, যিনি সংবাদমাধ্যমকেই প্রাথমিক ‘শত্রু’ হিসেবে ঠিক করেছেন।
ইন্টারসেপ্ট লিখেছে, সংবাদমাধ্যমকে বলা হয়ে থাকে সেই অস্ত্র, যা জনগণের মৌলিক অধিকারের রক্ষাকবচ এবং সরকার যা গোপন করতে চায় তা প্রকাশ করে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে। এই কারণে, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর গত ১৫ বছরের মধ্যে সংবাদমাধ্যম সবচেয়ে উদ্বেগজনক সময়ে পড়েছে।
/বিএ/