শরণার্থী বিপন্নতার হাঙ্গেরি সীমান্ত

‘পুলিশ আমাদের পেছনে কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল’

noname“পাঁচ-ছয়জন সেনা সদস্য আমাদেরকে একে একে নিয়ে গেল এবং পেটালো। তারা প্লাস্টিকের হাতকড়া দিয়ে হাতগুলোকে পেছন দিকে বেঁধে রাখলো। তারা সব কিছু দিয়ে আমাদেরকে পেটালো, ঘুষি দিলো, লাথি দিলো এবং লাঠিচার্জ করলো। তারা ইচ্ছে করেই আমাদের ওপর বাজেভাবে আঘাত করছিল। আমরা জানতে চাইলাম কেন তারা আমাদের পেটাচ্ছে। কিন্তু তারা কেবল বললো: ‘সার্বিয়ায় ফিরে যাও’। আমি কোনও সিনেমাতেও এ ধরনের পেটানোর দৃশ্য দেখিনি।” হাঙ্গেরি সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়ার বর্ণনা এভাবে দিচ্ছিলেন ৩৪ বছর বয়সী শরণার্থী ফরহাদ। তিনি একজন ইরানি নাগরিক।

গ্রিস উপকূল থেকে পশ্চিম ইউরোপে যাওয়ার পথে ফরহাদের মতো করেই সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছে লাখো মানুষ। হাঙ্গেরি সরকার এই প্রচেষ্টাকে বেআইনি বলছে। তবে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ‘ট্রানজিট জোন’-এর মাধ্যমে প্রতিদিন দুই সীমান্ত চৌকি দিয়ে সীমান্ত পারি দিতে পারে খুবই অল্প সংখ্যক শরণার্থী। বাকীদের বেপরোয়া পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে বলেই তারা অবৈধ পথে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ আচরণকে হাঙ্গেরি সরকারের শরণার্থীবিরোধী নীতিমালারই অংশ বলে দাবি করেছে। জাতিসংঘ সতর্কবার্তা দিলেও তা কানে তুলছে না হাঙ্গেরীর কট্টর ডানপন্থী সরকার। উপরন্তু ১৪ বছরের বেশি বয়সী শিশুসহ সকল প্রাপ্তবয়স্ক শরণার্থীকে সীমান্তবর্তী ক্যাম্পগুলোতে আটকের আদেশ দিয়ে বিতর্কিত একটি আইনে স্বাক্ষর করেছেন হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট জানোস আডের।

noname

শরণার্থীদের ঠেকাতে সার্বিয়া সংলগ্ন ১০০ মাইল ব্যাপী দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্তে হাজার হাজার নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন করেছে হাঙ্গেরি। অনবরত সম্প্রসারিত হচ্ছে কাঁটাতারের বেড়া। সেখানে রয়েছে তাপজনিত সেন্সর ও ক্যামেরা। ক্রমাগত লাউড স্পিকারে ইংরেজি, আরবি ও পার্সি ভাষায় বাজছে হুঁশিয়ারি বার্তা। ‘সাবধান, সাবধান। আপনাদের সতর্ক করা হচ্ছে যে এটা হাঙ্গেরি সীমান্ত। যদি আপনারা এ বেড়ার কোনও ক্ষতি করেন, অবৈধভাবে তা পাড়ি দেন কিংবা পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেন, তবে হাঙ্গেরির জন্য তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। এ ধরনের অপরাধ সংঘটন থেকে বিরত থাকার জন্য আমি আপনাদের সতর্ক করছি। আপনারা ট্রানজিট জোনে আপনাদের অভিবাসন সংক্রান্ত আবেদন জমা দিতে পারেন।’

কিন্তু সমস্যাটা হলো ‘ট্রানজিট জোন’-এর মাধ্যমে গুটিকয়েক শরণার্থীই প্রতিদিন দুই সীমান্ত চৌকি দিয়ে পারাপার করতে পারে। যার কারণে সার্বিয়া সীমান্তে অন্তত ৭ হাজার মানুষকে আটকা পড়তে হয়েছে। ভয়াবহ আর বেপরোয়া পরিস্থিতির মধ্যে তাদেরকে দিন কাটাতে হচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, শরণার্থীদের ওপর এ আচরণ হাঙ্গেরি সরকারের শরণার্থীবিরোধী নীতিমালারই অংশ। জাতিসংঘ থেকে বার বার এ ব্যাপারে সতর্কতা দেওয়ার পরও হাঙ্গেরির কট্টর ডানপন্থী সরকার তাতে কান দিচ্ছে না।

হাঙ্গেরি সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় আরও ২৯ জন নারী ও শিশুর পাশাপাশি পুলিশের বাধার মুখে পড়েন ফরহাদ। এরপর তাদের ওপর চলে নির্মম নির্যাতন। পুলিশের পোশাকধারীরা আটককৃতদেরকে মাটিতে বসতে বলে এবং মাথার পেছনে হাত নিয়ে যেতে বলে। এরপর শুরু হয় দুই ঘণ্টার আক্রমণ। ফরহাদ আরও অভিযোগ করেন, পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের মোবাইল ফোনে সেলফি তুলছিল এবং নির্যাতন চালানোর সময় হাসছিল। অভিবাসন প্রত্যাশীদের ওপর টিয়ার গ্যাস ছোড়া হচ্ছিল।

noname

একইদিন হাঙ্গেরি সীমান্তে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন শহীদ খান নামের এক পাকিস্তানি অভিবাসন প্রত্যাশী। ঘটনার ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘পুলিশগুলো যখন আমাদের পেটাচ্ছিল তখন তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকল। তারা আবার আমাদের সঙ্গে সেলফিও তুলছিল।’ শহীদ খান আরও অভিযোগ করেন, ‘ছবি তোলার পর হাঙ্গেরির পুলিশ আমাদের পেছনে কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল।’ ওই কুকুরগুলো তাদের ধাওয়া করতে থাকে। শহীদ বলেন, ‘তারা আমাদের সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করেছে। অথচ আমরা মানুষ।’

হাঙ্গেরি সীমান্তের ৫ মাইলের মধ্যে আসা শরণার্থীদেরকে আটক করে সার্বিয়ায় ফেরত পাঠানোর জন্য জুলাইয়ে হাঙ্গেরিতে নতুন একটি আইন বাস্তবায়িত হয়। গল বলেন, পুলিশি অভিযানের সময় ভিডিও করার একটি নীতি হাঙ্গেরিতে চালু আছে। শরণার্থীদের হাতে এক খণ্ড কাগজ ধরিয়ে দিয়ে তাদেরকে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করানো হয়। আর তো দেখে বোঝা যায়, তারা অনিয়মিত পদ্ধতিতে হাঙ্গেরিতে এসেছে। গল জানান, ‘ওই অফিসিয়াল ভিডিও যখন করা হয় তখন পুলিশ কর্মকর্তারা শরণার্থীদের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেন। কিন্তু অনেক শরণার্থী অভিযোগ করেছেন ভিডিও করা শেষ হওয়ার পরই তাদেরকে পেটানো শুরু হয় আর তার কোনও প্রমাণ থাকে না।’ গলের দাবি, ‘সাজানো’ ভিডিওর কারণে শরণার্থীদের অভিযোগগুলো হাঙ্গেরি সরকার ভালোভাবে তদন্ত করতে পারে না।

হাঙ্গেরি সীমান্তে পুলিশি নির্যাতনের শিকার ৩০ জনের দলে ছিলেন এমন আরেকজন হলেন ২৮ বছর বয়সী ইরানি নাগরিক এহসান। তিনি বলেন, ‘সীমান্ত বেড়া পাড়ি দিয়ে সার্বিয়ায় ফিরে যাওয়ার জন্য মানুষের সারিটির একেবারে শেষে ছিলাম আমি। তারা আমার ওপর কুকুর লেলিয়ে দিলো। আমি তার গলা চেপে ধরার চেষ্টা করলাম এবং মাটিতে পড়ে গেলাম। পাশ থেকে এক পুলিশ কর্মকর্তা আমার মুখে আঘাত করলো।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)-এর সংগ্রহে আসা একটি ছবিতে দেখা গেছে এহসানের চোখের পাশ দিয়ে আঘাতের চিহ্ণ আর সেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তার মুখমণ্ডলে থাকা আঘাতগুলো সারতে দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় লেগে গিয়েছিল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বলকান ও পূর্ব ইউরোপ শাখার গবেষক লিডিয়া গল বলেন, নির্যাতিত শরণার্থীদের সঙ্গে পুলিশ সেলফি তুলছে এবং তার ভিডিও করছে এমন অসংখ্য রিপোর্ট পাওয়া গেছে।

noname

এদিকে ১৪ বছরের বেশি বয়সী শিশুরাসহ সকল প্রাপ্তবয়স্ক শরণার্থীকে সীমান্তবর্তী ক্যাম্পগুলোতে আটকের আদেশ দিয়ে বিতর্কিত একটি আইনে স্বাক্ষর করেছেন হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট জানোস আডের। পার্লামেন্টারি ওয়েবসাইটের বরাত দিয়ে মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি জানায়, মানবাধিকার সংগঠনগুলো যখন বিলটির বিরুদ্ধে ভেটো দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছিল তখন তা উপেক্ষা করে বুধবার (১৫ মার্চ) বিলটিতে স্বাক্ষর করেন তিনি। হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে হাঙ্গেরির ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের স্মরণে পালিত জাতীয় ছুটির দিনে এ বিলটি আইনে পরিণত হলো। এ পদক্ষেপকে গভীর হতাশার বলে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। 

২০১৭ সালের শুরুর দিকে যখন ইউরোপজুড়ে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়ছিল এবং হাঙ্গেরির তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে নেমে গেল তখন আবার নতুন ধরনের নির্যাতনের কথা শোনা গেল। শরণার্থীদের অভিযোগ, সীমান্ত পুলিশ তাদের খাওয়ার পানি কেড়ে নিয়ে গায়ের ওপর সে পানি ঢেলে দিয়েছিল। এরপর জামা-কাপড়-জুতা খুলে নিয়ে তুষারের মধ্যে বসিয়ে রাখা হতো। সূত্র: দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট, এপি

/বিএ/