এইচআরডাব্লিউ এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন

মসজিদকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে ৩৮ বেসামরিক সিরীয়কে হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্র

যুদ্ধ-যাপনের ক্ষত বুকে নিয়েই ধর্মপ্রাণ সিরীয় মুসলিমদের নিত্যদিনের মসজিদে যাতায়াত। এমনই এক মসজিদে গত মার্চে মার্কিন বিমান হামলার কবলে পড়লে অন্তত ৩৮ বেসামরিক সিরীয় প্রাণ হারান। মসজিদকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে হামলা চালানোর কথা অস্বীকার করেছে মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন। তাদের দাবি, মসজিদের অবস্থান শনাক্তে ব্যর্থ হয়েছিল মার্কিন বাহিনী। তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথক দুই তদন্তের ফলাফল এই দাবিকে অস্বীকার করছে। তাদের তদন্ত  প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ওই মসজিদের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের আল কায়েদার সদস্য ভেবেছিল মার্কিন বাহিনী। তাই হামলার নিশানা বানানো হয়েছিল মসজিদটিকে।
মার্কিন বিমান হামলায় ক্ষতবিক্ষত সেই সিরীয় মসজিদ

সিরিয়ার আল-জিনাহ গ্রামের ওই মসজিদটি মার্কিন বিমান হামলার শিকার হয় এ বছরের মার্চে। এরপর মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে বেসামরিক হত্যার অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ অস্বীকার করেন পেন্টাগনের মুখপাত্র নেভি ক্যাপ্টেন জেফ ডেভিস। তার দাবি, মসজিদ তাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল না।

যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, ওই হামলায় বেশ কয়েকজন আল-কায়েদা নেতা নিহত হয়েছিলেন।

এইচআরডাব্লিউ এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় দুটি ড্রোন এবং চারটি মিসাইল হামলা চালানো হয়। দুইটি তদন্ত প্রতিবেদনেই বেসামরিক জীবন নিয়ে মার্কিন বাহিনীর নিস্পৃহতা ও অজ্ঞতার আলামত মিলেছে। মার্কিন গোয়েন্দাদের ব্যর্থতার কারণেই ওই ৩৮টি জীবন ঝরে পড়েছে বলে উঠে এসেছে ওই দুই তদন্তে।

পেন্টাগন মুখপাত্র ডেভিসের দাবি, মসজিদে হামলা তাদের ভুল ছিল। তিনি সাংবাদিকদের হামলার একটি ছবি দেখান। ছবিতে থাকা ক্ষতিগ্রস্ত এক দালান দেখিয়ে দিয়ে বলেন, এটা মসজিদটির  বাম পাশ। ডেভিস দাবি করেন, বিমান হামলার সময় তারা ওই দালানটির অবস্থান শনাক্ত করতে পারেননি।

তবে চলতি সপ্তাহে এ ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে মানবাধিকার সংস্থা এইচআরডাব্লিউ। এক প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে সংস্থাটি জানায়, হামলার সময় সেখানে ৩০০ মুসল্লি নামাজের জন্য জড়ো হয়েছিল। রিপার ড্রোন থেকে নতুন তৈরি মসজিদ ইবন আল খাতাবকে লক্ষ্য করে হেলফায়ার মিসাইল হামলা চালানো হয়। হামলায় অন্তত ৩৮ জন নিহত হন।

nonameএদিকে মসজিদকে হামলার লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে বলে আভাস দিয়েছে এইচআরডাব্লিউ। মার্কিন হামলায় মসজিদের ওয়াশরুম, টয়লেট, নামাজের স্থান ও রান্নাঘর ধ্বংস হয়েছে বলে জানিয়েছে তারা। এইচআরডাব্লিউ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, পেন্টাগন কর্তৃপক্ষ হামলা করা মসজিদটি চিনতে ভুল করার পাশাপাশি সেখানে বসবাস করা বেসামরিকদের ভুল করে জঙ্গি ভেবেছে।

স্থানীয়রা জানান, মসজিদে মাগরিবের ওয়াক্ত থেকে এশার ওয়াক্ত পর্যন্ত ধর্মীয় আলোচনা চলত। সেসময়ই হামলা চালায় মার্কিন ড্রোন। যুক্তরাষ্ট্র একটু চেষ্টা করলেই জানতে পারতো সেখানে কারা অবস্থান করছে। সন্ত্রাসী নয় বরং সাধারণ মুসল্লিরা সেখানে জড়ো হয়েছিল।

১৪ জন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার, ভিডিও এবং ছবির ভিত্তিতে তৈরি করা তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের উপ-পরিচালক অলে সোলভ্যাং। তার মন্তব্য, যুক্তরাষ্ট্র এই হামলায় ভয়াবহ কিছু ভুল করেছে আর এর মাশুল দিতে হয়েছে নিরপরাধ বেসামরিকদের।

হামলায় যে মসজিদটিকেই লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছিল, তা আরও স্পষ্ট হয় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেনসিক আর্কিটেকচার বিভাগের একটি ভিডিও প্রতিবেদনে। ইসরায়েলি স্থপতি ইয়াল উইজম্যানের নেতৃত্বে একদল গবেষক ওই প্রতিবেদন তৈরি করেন। এর আগেও তারা সিরিয়ায় যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করেছিল। সিরিয়া ছাড়াও ইসরায়েল, পশ্চিম তীর, গাজা, পাকিস্তান ও গুয়াতেমালায়ও তদন্তের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের। হামলার আগে এবং পরে দালানের মডেল বিশ্লেষণ ছাড়াও হামলার শিকার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেন ইয়াল উইজম্যানের দল।

noname

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত দালানে আজানের জন্য মাইক ছিল, মক্কার দিকে দিক নির্দেশনা ছিল। অর্থাৎ খুব স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল সেটা মসজিদ। সুতরাং তা শনাক্ত করতে না পারাটা অস্বাভাবিক।

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদন স্পষ্ট করে দেয়, নির্মাণশৈলীর কারণে খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে সেটা মসজিদ। হামলার পরপরই দুটো বোমার বিস্ফোরণে মসজিদের উত্তর অংশটি উড়ে যায়। পালানোর জন্য মসজিদের দক্ষিণাংশের ধ্বংসাবশেষ বেয়ে ‍উঠতে থাকে মুসল্লিরা। তারা পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবারও হামলা চালানো হয়।

ফরেনসিক আর্কিটেকচারারের অস্ত্র বিশেষজ্ঞ ক্রিস কব স্মিথ জানান, মিসাইলগুলো সম্ভবত হেলফায়ার মিসাইল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মার্কিন কর্মকর্তাও সেটা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, দুইটি রিপার ড্রোন থেকে চারটিরও বেশি হেলফায়ার মিসাইল ছোঁড়া হয়। ক্রিস দাবি করেন, মার্কিন ড্রোন অপারেটররা মসজিদ থেকে পালিয়ে যাওয়া মুসল্লিদের উপরও হামলা চালায়। ওই অপারেটরদের দাবি, মুসল্লিদের আল-কায়েদা সদস্য মনে হচ্ছিলো এবং তারা হামলা চালাচ্ছিল।

পেন্টাগনের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী সিরিয়া এবং ইরাকে মার্কিন হামলায় যথাক্রমে ১০২ ও ৩৯৬ জন বেসামরিক মারা গেছেন। ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেখানে ১৮ হাজার ৬৪৫টি হামলা চালিয়েছে। তবে প্রকাশিত নতুন প্রতিবেদনে এটা নিশ্চিত যে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়বে।

/বিএ/