হামাস: ধর্মভিত্তিক দল থেকে ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনের কণ্ঠস্বর

হামাসের প্রতি আস্থা রাখেন ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশআরববিশ্বে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের সম্মিলিত  কণ্ঠস্বর স্পষ্ট হয় ১৯৮৭ সালে । ইন্তিফাদা নামের সেই সময় শুরু হওয়া গণ-আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পরের বছর হামাসের আত্মপ্রকাশ। ধর্মভিত্তিক সংগঠনের পরিচয়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের সহযোগী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে তাদের। হামাসের প্রাথমিক ঘোষণাপত্র ছিল ইহুদি বিদ্বেষে ঠাঁসা। তবে ফিলিস্তিনি জনতার জাতিসত্তার বোধ জাতিরাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা জোরালো করে তুলতে শুরু করার পর, সেই পরিস্থিতির সমান্তরালে বদলে যেতে থাকে হামাস। এক পর্যায়ে ফিলিস্তিনি মুক্তির সংগ্রামই হয়ে ওঠে তাদের প্রধান অঙ্গীকার।

ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনের শরিক হওয়ার পর ২০০৬ সালের নির্বাচনে জনতার নিরঙ্কুশ সমর্থন নিয়ে সরকার গঠনেও সমর্থ হয়েছিল হামাস। সোমবার নতুন রাজনৈতিক দলিল প্রকাশ করতে গিয়ে আরও কিছু পরিবর্তনের ঘোষণা দেয় তারা। এর অন্যতম হলো, ঘোষণাপত্রে থাকা ইহুদি বিদ্বেষ থেকে সরে আসা। পাশাপাশি ৬৭’র সীমানা মেনে রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দিয়েছে হামাস। তাদের ঘোষণাপত্রে মুসলিম ব্রাদারহুড সংশ্লিষ্টতার উল্লেখ ছিল। পূর্বেই ব্রাদারহুডের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করলেও, এবারের নতুন রাজনৈতিক দলিলে স্বতন্ত্র সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দিয়েছে হামাস।

প্রথম ইন্তিফাদার সময়ে হামাসের প্রাথমিক ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল, ‘ইসরায়েলকে পুরোপুরি ধ্বংস করে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করাটাই সংগঠনের মূল লক্ষ্য।’ সেই সঙ্গে ইসলাম ও ইহুদী ধর্মের বিরোধকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে উল্লেখ করে এটিকে মতাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। ধর্মবাদী চেতনার আলোকে এক সংগঠন গড়ার কথা বলা হয়েছিল ওই ঘোষণাপত্রে।   

মূলত দ্বিতীয় ইন্তিফাদা, বা আল আকসা ইন্তিফাদার সময়কালে (২০০০–২০০৫) হামাসের রাজনীতিতে এক বিশেষ রূপান্তর ঘটতে শুরু করে। এ সময়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের মতাদর্শিক অবস্থানকে ছাপিয়ে যায় ফিলিস্তিনের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন। সেই আন্দোলনের প্রতি নিজেদের অঙ্গীবকার জানিয়েই রাজনৈতিকভাবে হামাস ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।

২০০৪ সালের ১৭ এপ্রিল হামাসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আবদেল আজিজ আল–রানতিসি ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত দায়িত্বে আসেন খালেদ মেশাল। একই বছর ১১ নভেম্বর ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট ফাতাহ নেতা ইয়াসির আরাফাতের জীবনাবসানের পর প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন (পিএলও) জনভিত্তি  হারাতে থাকে।

মূলত, ১৯৯৩ সালের ‘অসলো চুক্তি’র বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়লে ফিলিস্তিনে ফাতাহ ও পিএলওর জনসমর্থন কমে আসতে থাকে।  আরাফাত পরবর্তী যুগে পিএলও  যখন রাজনৈতিকভাবে ফিলিস্তিনি জনগণের পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়, ঠিক সেই সময়ে ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক ও প্রতিরোধ আন্দোলনের আস্থা অর্জনে সমর্থ হয় হামাস। ফিলিস্তিনে ২০০৬ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পায় তারা। তবে সরকার গঠনের পরপরই ইসরায়েল তাদের মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। আরাফাত-পরবর্তী  মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফাতাহও হামাসের সরকারে যোগদান থেকে বিরত থাকে।

ফাতাহ হামাসের ঐক্যবদ্ধ সরকার গঠনের আহবান প্রত্যাখ্যান করার পর রাজনৈতিক বিভেদ সহিংসতায় রূপ নেয়। পশ্চিম তীরে ফাতাহ তাদের পৃথক সরকার ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রাখে। অপরদিকে, অবরুদ্ধ গাজা থাকে হামাসের নিয়ন্ত্রণে। এরপর হামাস ও ফাতাহ বহুবার জাতীয় ঐক্যের সরকার প্রতিষ্ঠায় সম্মত হলেও তা বাস্তব হয়নি। তবে খালেদ মেশাল রাজনৈতিক নেতৃত্বে আসার পর থেকেই হামাস তার পূর্ববর্তী উগ্র ধর্মবাদী চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে।  ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রশ্নেও নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করতে শুরু করে তারা। ২০০৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং হামাসের অন্যতম প্রধান নেতা ইসমাইল হানিয়াহ বলেন, ‘হামাস ১৯৬৭ সালের সীমানাসহ ইসরায়েলের সাথে দীর্ঘমেয়াদী অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে রাজী আছে।’

২০১০ সালে হামাসের প্রধান রাজনৈতিক নেতা খালেদ মেশাল বলেন, “‘হামাস চার্টার’ (হামাসের ঘোষণাপত্র) এক ইতিহাসের অংশ, কিন্তু তা এই মুহূর্তে প্রয়োজনীয় কিছু নয়। হামাস যখন থেকে পরিস্থিতিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করাকেই প্রধান বলে মনে করেছে, তখন থেকেই  ঘোষণাপত্র থেকে সরে এসেছে।”

২০১৩ সালের এক সাক্ষাৎকারে খালেদ মেশাল বলেন, ‘ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় এই আলোচনা অর্থহীন। আমরা উগ্র হত্যাকারী নই। আমরা আসলে ইসরায়েল-বিরোধীও না। তাদের দখলদারিত্বের বিরোধী। এর অবসান ঘটাতে পারলে আমরা আমাদের নীতি–মূল্যবোধ নিয়ে কাজ করব। সেই নীতি ও মূল্যবোধ গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং বহির্বিশ্বের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে অঙ্গীকারাবদ্ধ।’

২০১৪ সালের জুলাইয়ে খালেদ মেশাল  বলেন, ‘ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাই। তবে সেক্ষেত্রে ইসরায়েলের ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করতে হবে। আলোচনার কথা বলে আগ্রাসন চালালে সেটি তো মেনে নেওয়া যায় না।’ ওই সাক্ষাঃকারে দ্বি-রাষ্ট্র সমধান মেনে নেওয়ারও ইঙ্গিত দেন মেশাল। “মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও হাতে গোনা কয়েকটি পশ্চিমা রাষ্ট্রের অন্ধ সমর্থনে ইসরায়েল আজ ‘মধ্যপ্রাচ্যের বখে যাওয়া সন্তানে’ পরিণত হয়েছে। ইসরায়েল আজ কাউকে মানছে না, মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার মার্কিন মিশনে বড় রকমের ফাঁকফোকর রয়েছে। ২০০৯ সালে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত দূর করে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার প্রত্যয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবাম যে রোডম্যাপের বিষয়ে কথা বলেছিলেন, তাও মানতে নারাজ ইসরায়েল। মূলত ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না।”

২০১৪ সালের জুলাইয়ে সিবিএস চ্যানেলে আরেক সাক্ষাৎকারে মেশাল বলেন, ‘আমরা গোঁড়ামীবাদী নই, আমরা মৌলবাদী নই। আমরা প্রকৃতপক্ষে ইহুদি জনগণের বিরুদ্ধে লড়াই করছি না। আমরা অন্য কোনও বর্ণের বা জাতির বিরুদ্ধে লড়াই করছি না, আমরা লড়াই করছি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে।’

মেশালের বক্তব্যে উঠে আসা হামাসের রাজনৈতিক ওই বদলগুলোস এবার প্রথম বারের মতো রাজনৈতিক দলিলে স্বীকৃত হলো।

হামাসের নতুন রাজনৈতিক দলিলে স্পষ্ট করে বলা হয়, হামাসের লড়াই জায়নবাদের বিরুদ্ধে। তা ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে নয়। সেখানে বলা হয়, ‘যে জায়নবাদী ইসরায়েলি নাগরিকরা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে রেখেছে, তাদের বিরুদ্ধেই লড়াই করছি আমরা।’ নতুন দলিলে মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা স্পষ্ট করে বলা হয়, ‘হামাস একটি স্বতন্ত্র সংগঠন।’

খালেদ মেশাল ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নে হামাসের অবস্থান সম্পর্কে বলেন, ‘নতুন নীতিতে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার কোনও সুযোগ রাখা হয়নি। তবে আমরা ১৯৬৭ সালের ৪ জুন যে সীমান্ত নির্দেশ করা হয়েছিল, তার ভিত্তিতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে আগ্রহী। যার রাজধানী হবে জেরুজালেম, আর সব শরণার্থী ফিরে পাবে তাদের নিজ নিজ ঘর ফিরে পাবে।’  সূত্র: আলজাজিরা, বিবিসি, ইনডিপেন্ডেন্ট, সিবিএস, সিএনএন

/বিএ/