রামপাল ও সুন্দরবন নিয়ে ইউনেস্কোর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে যা আছে

ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের সভায় সুন্দরবন ও রামপাল নিয়ে গৃহীত সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। পোল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের ৪১তম সভায় ১২ জুলাই তারিখে ওইসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্তগুলো রবিবার (৩০ জুলাই) ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এতে সুন্দরবন এলাকার কৌশলগত পরিবেশ মূল্যায়নের (এসইএ) আগে সেখানে বড় কোনো শিল্প বা অবকাঠামো নির্মাণ না করার বিষয়টি নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে সরকারকে। এসইএ শেষ করে যত দ্রুত সম্ভব এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি পর্যালোচনার জন্য হেরিটেজ সেন্টারে পাঠাতে বলা হয়েছে।
noname

ইউনেস্কো জানিয়েছে, ২০১৯ সালে হেরিটেজ কমিটির ৪৩তম অধিবেশনে এসব প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হবে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত সংক্রান্ত ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সুন্দরবন ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে দুই পৃষ্ঠার সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। সেখানে গৃহীত ১১টি সিদ্ধান্তের হুবহু ভাষান্তর তুলে ধরা হলো:

১. ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির সদস্যরা সুন্দরবন এলাকা ভিজিট করে যে প্রতিবেদন দিয়েছিল সেই ডব্লিউএইচসি/১৭/৪১.সিওএম/৭বি নামক নথিপত্র যাচাই করা

২. ২০১৫ সালে জার্মানির বনে বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের ৩৯তম অধিবেশনে গৃহীত হওয়া ৩৯ সিওএম ৭ বি.৮ সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করা। সেই সিদ্ধান্তে বলা হয়েছিল,

৩. বাংলাদেশের ওরিয়ন পাওয়ার প্ল্যান্ট ও রামপাল পাওয়ার প্ল্যান্টের দ্বিতীয় পর্যায় অনুমোদন না করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো

৪. বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় স্ট্রাটেজিক এনভায়রনমেন্টাল অ্যাসেসমেন্ট (এসইএ) নামক সমীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত স্বাগত জানানো এবং এই সমীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই অঞ্চলে কোনও বড় আকারের শিল্প বা অবকাঠামোগত উন্নয়নের অনুমতি না দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়। সমীক্ষাটি শেষ হওয়ার পর  অপারেশনাল গাইডলাইনের ১৭২ অনুচ্ছেদ মেনে যত দ্রুত সম্ভব তার একটি কপি আইইউসিএন দিয়ে পর্যালোচনার জন্য ‌বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রে পাঠাতে বলা হয়।

৫. বাস্তুসংস্থানগত পর্যবেক্ষণ নিয়ে তথ্য দেওয়ার জন্য স্বাগত। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণের প্রবেশ, স্বাদু পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার বিষয়গুলো সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থানের ওপর যে হুমকি সৃষ্ট করেছে, তা নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের জন্যও স্বাগত। সম্পদের ওপর এই ধরনের হুমকির প্রভাব পড়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে সিদ্ধান্ত টানা হয়। 

৬. বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবনের ব্যাপারে বাংলাদেশ (সুন্দরবন) ও ভারতের (সুন্দরবন ন্যাশনাল পার্ক) নিয়ে আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে সহযোগিতা বাড়ানোর প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে দুই দেশের সরকারের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। প্রপার্টিতে পর্যাপ্ত স্বাদু পানির প্রবাহ নিশ্চিত করার বিষয়ে ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর মিশনের করা সুপারিশ পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

৭. রামপাল প্রকল্প নিয়ে ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর রিঅ্যাক্টিভ মনিটরিং মিশনের করা অন্যান্য সুপারিশও পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নে ধারাবাহিক পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়।

৮. ‘ন্যাশনাল ওয়েল স্পিল অ্যান্ড কেমিক্যাল কন্টিনজেন্সি প্ল্যান’-এর (এনওএসসিওপি)খসড়া তৈরির অগ্রগতিকে স্বাগত। সেই সঙ্গে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল যোগানো এবং মানবসম্পদের ব্যবহার নিশ্চিত করতে অনুরোধ জানানো হলো। সাম্প্রতিক নৌ-দুর্ঘটনাগুলোতে বিপজ্জনক উপাদান ছড়িয়ে পড়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পর্যবেক্ষণ নিয়ে আরও তথ্য দিতে হবে। নৌ-চলাচলের কারণে ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে নৌ-চলাচল ব্যবস্থাপনা, ড্রেজিংয়ের মতো বিষয়গুলো সম্পর্কেও তথ্য দিতে হবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

৯. পশুর নদে পরবর্তী কোনও ড্রেজিং কার্যক্রম চালানোর আগে সুন্দরবনের আউটস্ট্যান্ডিং ইউনিভার্সাল ভ্যালুর (ওইউভি) ওপর এর প্রভাব নিয়ে সমীক্ষা চালানোর অনুরোধ জানানো হলো। সেই সঙ্গে কৌশলগত পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করারও অনুরোধ জানানো হয়।

১০. রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করা হলে সুন্দরবনে পরিবেশগত প্রভাব পড়বে বলে কমিটি উদ্বিগ্ন। এতে বায়ু ও পানিদূষণ বাড়বে। নৌচলাচল ও ড্রেজিং বেড়ে যাবে। স্বাদু পানি কমে যাবে। এর মধ্যেই ওই অঞ্চলের পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ৪১তম অধিবেশন ডব্লিউএইচসি/ ১৭ / ৪১. কম/ ১৮, পি ১০৪ অনুসারে কমিটি স্ট্রাটেজিক এনভায়রনমেন্টাল অ্যাসেসমেন্ট(এসইএ) এর অংশ হিসেবে এসবের প্রভাব নিরূপণ নিশ্চিত করতে হবে বাংলাদেশকে। ঝুঁকি কমাতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। সুন্দরবনের আউটস্ট্যান্ডিং ইউনিভার্সাল ভ্যালুর (ওইউভি) ওপর ক্ষতিকর প্রভাব এড়াতে বাংলাদেশকে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়।

১১. সবশেষে বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ, সম্পদের সুরক্ষামূলক অবস্থা এবং উপরে  যেসব সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বরের মধ্যে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির কাছে জমা দিতে হবে। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় কমিটির ৪৩তম অধিবেশনে ওই প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন সহ আরো কিছু পরিবেশগত বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটে বিগত ৩৯ তম সভার 7B নামবার সিদ্ধান্ত অনুসারে ২০১৬ সালের ২২ থেকে ২৮ মার্চে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির সদস্যরা সুন্দরবন এলাকা ভিজিট করে একটা প্রতিবেদন জমা দেয়। সেই প্রতিবেদন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া জবাব এবং আরও কিছু তথ্য একত্রিত করে ৩ জুলাইয়ে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির ২১ সদস্যের ৪১ তম সভায় সুন্দরবনকে ডেঞ্জার লিস্টে নেওয়া হবে কিনা এইটা নিয়া আলোচনা করা হয়। আলোচনা শেষে ১২ জুলাই সিদ্ধান্তগুলো গৃহীত হয়।

/এফইউ/বিএ/