মরদেহকে প্রচারণার অস্ত্র বানাচ্ছে মিয়ানমার

পরপর দুই দিনে দুই দফায় হিন্দু গণকবরের সন্ধান পাওয়ার দাবি করেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। সরকারের দাবি অনুযায়ী, মুসলিম বিদ্রোহীরা এই হিন্দুদের হত্যা করেছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, মিয়ানমার সংঘাতের মাঝখানে পড়ে যাওয়া নিহত হিন্দুদের মরদেহ এখন প্রচারণার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, কয়েক দিন চলে গেলেও সেগুলোর সৎকার করা হয়নি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মিয়ানমারের এই ভূমিকাকে ‘মরদেহের রাজনীতি’ আখ্যা দিয়েছে। আর স্বনামধন্য একজন মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ সাফ জানিয়েছেন, তিনি এসব বিশ্বাস করেন না। উল্টো তিনি প্রশ্ন করেছেন, এত এত রোহিঙ্গার প্রাণহানী হচ্ছে, অথচ তাদের গণকবর পাওয়া যায় না কেন? এইসব ‘প্রচারণা’ কৌশলের সঙ্গে সংযোগ পাওয়া যায়, মিয়ানমার টাইমস-এর সম্পাদকের সাম্প্রতিক এক মন্তব্যের। সত্য প্রকাশ নয়, যে কোনোভাবে মিয়ানমারের ইতিবাচক ভারমূর্তি নির্মাণ করার চেষ্টাকেই তিনি সাংবাদিকতা মনে করছেন।

9315DAAE-62FE-4064-8C6E-1E4897FF0877_w1023_s

চলতি সপ্তাহে রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ৪৫ জন হিন্দুর লাশ একটি গণকবরে পাওয়ার দাবি করে। এরপর তা মিয়ানমারের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক আকারে কাভারেজ পায়। এতে করে দীর্ঘদিন ধরে চলমান ক্ষমতাসীন বৌদ্ধ ও মুসলিমদের সংঘাত  নতুন মোড় দেয়। রবিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) গণকবরের সন্ধান পেলেও বুধবার পর্যন্ত সেগুলোর শেষকৃত্য শেষ করা হয়নি। ওইদিন সেনাবাহিনী ইয়াঙ্গুন থেকে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে হিন্দুদের লাশ দেখানোর জন্য নিয়ে যায়। ঘাসের ওপর ছড়িয়ে থাকা হিন্দুদের লাশগুলো দেখানো হয় সাংবাদিকদের। একই সঙ্গে হিন্দুদের ওপর রোহিঙ্গা মুসলিমদের সহিংসতার বর্ণনা দেওয়া হয়। ঘটনাস্থলে পুলিশ কর্মকর্তা ওক্কার কো বলেন, ‘আমরা এই পাশ থেকে (স্থানীয়) যে তথ্য পাচ্ছি, তা অনুসরণ করছি। যেখানে মাটি অসমতল মনে হচ্ছিল সেখানেই গর্ত খুঁড়তে শুরু করি আমরা। এরপর দুর্গন্ধ পাই।’

২৫ আগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্যরা ৩০টি পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালালে সর্বশেষ এই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে রাখাইন রাজ্যে। মিয়ানমার সরকারের দাবি, এর কয়েকঘণ্টা পরই আরসা সদস্যরা হিন্দুদের গ্রাম ইয়ে বাউ কিয়াতে প্রবেশ করে। তারা গ্রামের শতাধিক মানুষকে জড়ো করে। বন্দুকের মুখে তাদের ধানের ক্ষেতের দিকে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের ছুরিকাঘাতে হত্যা করে আরসা সদস্যরা।

রাখাইনের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা রক্তাক্ত এই সংঘর্ষে কিভাবে জড়িয়ে পড়ল, তা পরিষ্কার নয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তি আলাদা আলাদা কারণ ও বক্তব্য দিচ্ছেন। কয়েকজন গ্রামবাসীর মতে, হিন্দুরা সরকার পক্ষের এবং সরকারের হয়ে গোয়েন্দাগিরি করছে বলে মনে করে মুসলিমরা। তবে আগস্ট মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা হিন্দু নারীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে রয়টার্স। ওই নারীরা জানান, রাখাইন বৌদ্ধরা তাদের স্বামীদের হত্যা করেছে। তবে রয়টার্সের কাছে ওই তিন নারী প্রকৃত ঘটনা ফাঁস করেন। তারা রয়টার্সকে জানান, যিনি তাদের বাংলাদেশে নিয়ে এসেছেন তিনি তাদের নির্দেশ দিয়েছেন, হত্যাকারী হিসেবে যেন রাখাইন বৌদ্ধদের নাম বলা হয়। এই তিন নারীর বক্তব্য প্রায় কাছাকাছি। তারা জানান, ২৫ আগস্ট তাদের ও শতাধিক হিন্দুদের মুখোশধারী লোকেরা সারিবদ্ধ করে গণকবর আবিষ্কার হওয়া এলাকায় নিয়ে যায়। পরে তারা মুখোশধারী কয়েকজনকে রোহিঙ্গা মুসলিম বলে চিনতে পেরেছেন। যদিও নারীরা জানান, লোকটি একাধিক ভাষায় কথা বলতে পারেন বলে তারা একেবারে শনাক্ত করতে পারেননি।

710177F3-E32C-494D-B298-F3622AE46C54_w1023_s

ওই তিন নারীর একজন বিনাবালা (২২) জানান, ‘তারা (মুসলিম) প্রত্যেকের হাত পেছনে নিয়ে বেঁধে ফেলে, পাও বাঁধে। তারা সবার গলা কেটে গর্তে ফেলে দেয়।’ ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিলে হিন্দু নারীদের ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জানান তিনি। ওই নারীরা জানান, হামলাকারী হিন্দুদের দেওয়া সরকারি পরিচয়পত্র নিয়ে আপত্তি জানায়। তারা দাবি করে, এই পরিচয়পত্র হিন্দুদের নয়, মুসলমানদের পাওয়া উচিত। হিন্দুদের মরদেহগুলো পরীক্ষা করেছেন মংডু শহরের হাসপাতালের সুপার কিয়াইউ মাউং মাউং। তিনি জানান, নিহতদের চোখ ও হাত বাঁধা এবং গলাকাটা ছিল। রাষ্ট্র পরিচালিত সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমারকে তিনি বলেন, ‘যেসব তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে, তা আরসা সন্ত্রাসীদের হত্যাযজ্ঞের ইঙ্গিত দেয়। এই অভিযোগ যখন চারদিকে ছড়াচ্ছে হিন্দুদের মরদেহগুলো শেষকৃত্যের অপেক্ষায় পড়ে আছে। পুলিশ গণকবরটি পাহারা দিচ্ছে, রাতে আলো জ্বালিয়ে রাখছে, যাতে করে বন্য কুকুর এসে হামলা না চালায়।

রাখাইনে সাংবাদিক প্রবেশে বাধানিষেধ থাকায় কোনও সংবাদমাধ্যমের পক্ষে স্বাধীনভাবে ঘটনাটি যাচাই-বাছাই করা যায়নি। তবে বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) এক বিবৃতিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, আরসার ওপর হিন্দুদের হত্যার দায় চাপিয়ে সরকার বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা নিধন সংক্রান্ত ঘটনার যথাযথ তদন্তে নিজেদের অনাগ্রহকেই প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পোড়া কিংবা ছুরি-বন্দুক কিংবা অন্যকিছু দিয়ে ভয়ঙ্কর জখম করা দেহ, তাদের ওপর যৌন সহিংসতার আলামত বিশ্লেষণ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এরইমধ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের মানবতোবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ এনেছে।

মিয়ানমারকে বার্মা নামে সম্বোধন করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সরকারের উচিত এর সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনতার পাশাপাশি হিন্দু-মুসলিমদেরও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। নিরাপত্তাজনিত হুমকি মোকাবিলা করা সরকারের দায়িত্ব বটে। তবে আইনের শাসনের সীমার মধ্যে থেকেই তা করা উচিত।

হিন্দুদের হত্যা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে আরকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ)। তাদের দাবি, তারা বেসামরিকদের ওপর কোনও হামলা চালায় না এবং কোনও হিন্দুকেও হত্যাও করেনি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর দাবি, মিয়ানমারের মরদেহ নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করা উচিত। সামরিক নৃশংসতার অবসান ঘটিয়ে জাতিসংঘের তদন্ত দলকে রাখাইনে প্রবেশ করতে দেওয়া উচিত, যেন সব ধরনের অপরাধের যথাযথ তদন্ত করা যায়।

burma-bangladesh

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস-এর গবেষক জারনি। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সংস্কারের পক্ষে সরব ছিলেন তিনি। ২০০৪ সালে সামরিক শাসনের কবল থেকে বাঁচতে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এই গবেষক। মিয়ানমার বিষয়ের একজন স্বীকৃত গবেষক তিনি। সেই জারনি বলছেন, ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়েছেন। ওই সময় থেকেই মুসলিমবিরোধী প্রচারণা জোরদার হয়। সন্ত্রাসী-জিহাদি পরিচয়গুলো সামনে আসতে থাকে। সাম্প্রতিক সহিংসতা নতুন মাত্রা পেয়েছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক হামলা বাকি সবকিছুকে হার মানিয়েছে বলে মনে করেন জারনি। সরকারের প্রচারণাকে বিশ্বাস করেন না  তিনি। সম্প্রতি ২৯ জন হিন্দুর মরদেহসহ গণকবরের সন্ধানের সংবাদ নিয়েও অবাক হন তিনি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সু চিকে সমর্থন দেওয়ার পর এমন ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি এগুলো একদমই বিশ্বাস করি না। হাজার হাজার মানুষ হত্যা করা হয়েছে, তাদের মরদেহ কোথায়? তাদের গণকবর কোথায়?’ তিনি বলেন, ‘এই তথ্য মিয়ানমার সরকারের দাবি করা। কোনও স্বাধীন সূত্র থেকে পাওয়া নয়।’

জারনির মতে,  মিয়ানমারের উচিত, জাতিসংঘকে ঘটনার তদন্ত করতে দেওয়া। তারাই তদন্ত করে জানাবে। এই গণকবরের বিষয়টির সত্যতা নির্ধারণ করবে। জার্নি বলেন, ‘মিয়ানমারের সামরিক জান্তা থেকে গণতান্ত্রিক সরকারে রূপান্তরিত হওয়ার সময় অন্য মাত্রায় ছিলেন সু চি। তবে রোহিঙ্গা ও মুসলিম ইস্যুতে সামরিক জান্তার সঙ্গে তার কোনও পার্থক্য নেই। তারা দু’জনই একই আচরণ করছেন।’  জারনি জানান, বর্তমানে মিয়ানমারের সামরিক স্কুল থেকে ১০ হাজার সেনা ক্যাডেট প্রশিক্ষিত হয়ে আসছে। জার্নি দাবি করেন, ‘তাদের প্রত্যেককে সামাজিক মাধ্যমে দুই ঘণ্টা করে মুসলিমবিরোধী, রোহিঙ্গাবিরোধী প্রচারণা চালাতে বলা হয়েছে। সাধারণ মানুষও এর বিরোধিতা করতে পারে না। কারণ, তারা মিথ্যাটাকেই সত্যি মনে করে।’

১১ আগস্ট থেকে ১৩ আগস্ট মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক উত্তরণ বিষয়ক এক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সেই আলোচনায় ছিলেন ‘মিয়ানমার টাইমস-এর সম্পাদক ও নির্বাহী পরিচালক কাভি চংকির্তাভন। আলোচনায় তার চাকরিগত দায়িত্ব ব্যাখ্যা করেছেন চংকির্তাভন। বর্তমান সরকারের অধীনে মিডিয়ার ভূমিকা কী, এমন এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি সাফ বলেন, ‘সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো মিয়ানমার সংক্রান্ত ইতিবাচক বয়ান নির্মাণ করা। আপনি অং সান সু চির মন্তব্য পড়েন, কিংবা নিউ লাইট অব মিয়ানমার পড়েন কিংবা যাই পড়ছেন, তার সবকিছুই আসছে সরকারের পক্ষ থেকে। এই সরকার মিয়ানমারের ইতিবাচক ভাবমূর্তি নির্মাণ করতে চায়, যা একেবারেই অনুপস্থিত। ’

‘যা দরকার, তা হলো বিপুল সংখ্যক মানুষের একই জিনিস বিশ্বাস করা।’ মন্তব্য কাভি চংকির্তাভনের।