নবজাতকদের নিয়ে বিপাকে শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গা মায়েরা

nonameপ্লাস্টিক ও বাঁশের তৈরি একটি তাঁবু আবাসন। প্রতিটি তাঁবুতে দুই থেকে তিনটি পরিবারের বসবাস। এই পরিবারগুলোর একেকটির সদস্য সংখ্যা অন্তত পাঁচজন। সেখানে কোনও খোলা জায়গা নেই; শুধু মানুষই দেখা যায় ওখানে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সবচেয়ে বড় অংশটির ঠাঁই হয়েছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে। ত্রাণকর্মীরা  বলছেন, এদের মধ্যে ৬০ থেকে ৮০ শতাংশই নারী ও শিশু। এই শিশুদের মধ্যে বিশেষ করে নবজাতকদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তাদের মায়েরা। চলতি বছরের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনযজ্ঞ শুরু হলে জীবন বাঁচাতে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন।

২৭ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির এলাকায় একজন বয়স্ক নারীকে দেখে যেন হোঁচট খান ডব্লিউএফপি-এর সিনিয়র মুখপাত্র সিল্কি বাহর। জরিনা নামের এই নারীর বসবাস একটি রোহিঙ্গাদের একটি তাঁবুতে। সেখানে তার এক অকালজাত শিশুও রয়েছে।

নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে গর্ভবতী কন্যাকে সঙ্গে করে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন তিনি। এই দুর্গম পথ অতিক্রম করতে ১১ দিন সময় লেগেছে তাদের। কন্যার এমন অবস্থার মধ্যেও জীবন বাঁচাতে এ যাত্রার বিকল্প জানা নেই তাদের। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সীমান্তের নোম্যান্স ল্যান্ডে সন্তান প্রসব করে জরিনার কন্যা। কিন্তু এই শরীরের দীর্ঘ যাত্রায় বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে নবজাতকের মা।

বাংলাদেশের আসার পর তাদের স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নেওয়া হয়। নবজাতকের নানী শিশুটিকে নিয়ে সদ্য মা হওয়া অন্যদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেন; যেন তার কন্যার অবস্থার কিছুটা উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত শিশুটিকে তারা আশ্রয় দেয়। সিল্কি বাহর বলেন, ওই নবজাতকের মা আসলে বিদ্যমান পরিস্থিতির একটা দৃষ্টান্ত। ডব্লিউএফপি-এর এ সিনিয়র মুখপাত্রে গলা ভারী হয়ে আসে। আবেগপ্রবণ কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘এই মানুষগুলো রাষ্ট্রহীন। মিয়ানমার তাদের নাগরিকত্ব দেয়নি। তারা বাংলাদেশেরও নাগরিক নয়। আমি জানি না; তারা কোথা থেকে এসেছে।

জরিনা’র পাশের তাঁবুতেই থাকছেন সদ্য মা হওয়া তরুণী রহিনা। তবে এই দুর্বল শরীরে নিজের ২০ দিনের শিশুর সেবাযত্ন করা তার জন্য সম্ভব নয়। নবজাতকের লালন-পালনে ভরসা এখন ওয়ার্ল্ড ভিশন প্রতিনিধির দেওয়া গুঁড়ো দুধ। নবজাতকের জন্য পর্যাপ্ত দুধ উৎপাদনের জন্য যে খাবারদাবারের প্রয়োজন সেটা রহিনা’র নেই। নিজ দেশ, ঘরবাড়ি ছেড়ে ভিন দেশে শরণার্থীর জীবন, নবজাতক সন্তানকে মায়ের দুধ খাওয়াতে না পারার মধ্যেই রহিনা’র দুঃখগাঁথার  যবনিকাপাত ঘটে না। চোখের সামনে নিজ ঘরে বার্মিজ সেনাদের হাতে স্বামীর নির্মম হত্যাকাণ্ড তাকে এখনও তাড়িয়ে বেড়ায়। হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে কাঁদতে শুরু করেন।

এই জরিনা কিংবা রহিনারা একজন দুইজন নয়। মিয়ানমার সরকারের জাতিগত নিধন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় প্রত্যেকের এমন এক বা একাধিক গল্প রয়েছে। লাখ লাখ মানুষের সে গল্প আসলে নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, গণহত্যা আর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের।

এমন বিভৎসতার সাক্ষী হয়েই সবুজ ধানক্ষেত, বন জঙ্গল আর বিপজ্জনকভাবে উঁচু খাড়া পাহাড়ি এলাকা পাড়ি দিয়ে রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। পেছনে ফেলে এসেছেন পূর্বপ্রজন্মের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িঘর, ক্ষেতভরা ফসল আর বহু কষ্টে গড়ে তোলা ব্যবসা বাণিজ্য। যে যেভাবে পেরেছেন দৌড়ে পালিয়েছেন। এই পালিয়ে যাবার পথে স্মৃতিকাতর হয়ে পেছনে তাকাতেই দেখছেন নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে এখনও উড়ছে আগুনের লেলিহান শিখা। সেনাদের লাগিয়ে দেওয়া সে আগুন যেন তাদের হৃদয়কে আরও ক্ষতবিক্ষত করে তুলছে। যেন পুড়িয়ে ছাঁই করে দেওয়া হয়েছে তাদের পূর্বপ্রজন্মের স্মৃতি আর ঐতিহ্যকে। এই মানুষগুলো সঙ্গে করে কোনও খাবার নিয়ে আসতে পারেনি। যে যতটুকু পেরেছে হাতে বা পিঠে থাকা ব্যাগে করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী যতদূর সম্ভব নিয়ে এসেছেন।

ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ-এর ন্যাশনাল ডিরেক্টর ফ্রেড উইটেভিন। তার ভাষায়, ‘মানুষের এমন হতাশা আমি ইতোপূর্বে কখনও দেখিনি।’ ফ্রেড উইটেভিন বলেন, আমরা একটি চমৎকার শহরে থাকি। তবে এখানে আমরা যতই প্রতিক্রিয়া দেখি না কেন, এখনও একটি ফাঁক আছে। মানুষ শুধু বেঁচে থাকার জন্যই বসবাস করছে। আমাদের একটা সামগ্রিক পদ্ধতি দরকার; যাতে আমরা অনেক বেশি অবদান রাখতে পারি।’

ওয়ার্ল্ড ভিশন ত্রাণ সংস্থাগুলোর কাছে বেশ পরিচিত। শরণার্থীদের প্রয়োজনীয় ত্রাণ, তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন তার সংস্থা। তাদের এ উদ্বেগ বাড়ছেই। ফ্রেড উইটেভিন বলেন, তাদের অবস্থা নিয়ে এখনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার দরকার।

noname

বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গাদের ঝুঁকিপূর্ণ দীর্ঘ যাত্রায় কারও সঙ্গী তাদের বয়োবৃদ্ধ মা-বাবা। কারও সঙ্গে হয়তো নবজাতক বা ছোট্ট শিশুরা। আছেন গর্ভবতী নারীরাও। এতোটা পথ পাড়ি দেওয়ার শক্তি হয়তো তাদের নেই। তাই কয়েকজন মিলে কাঁধে বাঁশ নিয়ে সেই বাঁশের সঙ্গে ঝুড়ি বা চেয়ার বেঁধে তাতে করে মা-বাবাকে নিয়ে আসছেন অনেকে। কেউবা আবার বৃদ্ধদের পিঠে নিয়েই পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘ পথ। শিশুদের নিয়ে আসছেন বেতের ঝুড়িতে। পানিপথে কোথাও বুক সমান আবার কোথাও প্রায় নাক পর্যন্ত পানিতে শিশুদের উঁচুতে তুলে ধরে পালিয়ে আসছেন অনেকে।

এমন ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রার অনেকটাই সম্পন্ন হয় রাতের বেলায়। বর্মি সেনাবাহিনী আর উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের চোখের অন্তরালে। তবে রাতের আঁধারও তাদের পুরোপুরি নিস্তার দেয় না। রোহিঙ্গাদের পালানোর পথও বন্ধ করে দিতে সীমান্তজুড়ে মাইন পেতে রেখেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এসব মাইনের ইতোমধ্যে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। এতোগুলো ধাপ নিরাপদে অতিক্রমে সক্ষম হলে মাছ ধরার নৌকায় করে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করেন রোহিঙ্গারা।

বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে কখনোই বাংলাদেশে আসতে চাননি ৯৭ বছরের নাজির হোসেন। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার সহ্য না করতে পেরে তিন ছেলে আগেই বাংলাদেশে এসেছেন। শুধু একাই বাড়িতে রয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কারণ সেখানে তার দাদা-দাদি থেকে শুরু বাবা-মা ও স্ত্রীর কবর। সেই জন্মভূমিতেই প্রিয়জনদের পাশে চিরনিন্দ্রায় শায়িত হওয়ার শেষ ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এবারের রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ তাকে নিজের ভিটেমাটিতে থাকতে দেয়নি। বাধ্য করেছে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হতে দেখছি, বাংলাদেশ স্বাধীন হতে দেখছি। আমার  ৯৭ বছর বয়সে এমন বর্বরতা দেখিনি।’

নাজির হোসেন সম্প্রতি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার পূর্বপুরুষ রাইখাইনের বাসিন্দা। আমরা খুব ধনী ছিলাম। ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার আগে ভারতের একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছি। মিয়ানমারের বলিবাজার থানার নাগপুরায় থাকতাম। ওই এলাকায় ১৬ কানি আবাদি জমি আছে।’ ২৭ আগস্ট রাতে সেনাবাহিনী তার গ্রামে আগুন দেয়। জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসেন বাংলাদেশে।

সূত্র: দ্য স্টার, দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি।