২০১৭: প্রবৃদ্ধির উল্লম্ফন বনাম দুর্ভিক্ষের থাবা

২০১৭ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি চিকিৎসা ও মহাকাশ গবেষণায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে। এইচআইভি ও ক্যান্সার চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জনের দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা। অন্য বছরের মতো এই বছরও ক্ষমতাশালীদের আর্থিক কেলেঙ্কারি ও নজরদারির বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছে উইকিলিকস ও ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে)-এর মতো সংগঠনগুলো। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এলেও ঠেকানো যায়নি দুর্ভিক্ষ। আর একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হওয়ার পরও বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে দায়ী দেশগুলোর মধ্যে বরাবরের মতোই অনীহা দেখা গেছে।

সোমালিয়ায় দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করে জাতিসংঘ
বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি

২০১৭ সালে বিশ্বজুড়ে ভালো রকমের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। দশ বছর আগে বৈশ্বিক মন্দা শুরু হওয়ার পর থেকে এবারই সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। ২০১৭ সালে প্রবৃদ্ধির দিক দিয়ে বেশ উজ্জ্বল অবস্থানে ছিল ইউরো অঞ্চলের দেশগুলো। এ অঞ্চলে দশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে এবং বেকারত্বের হার কমে ৯ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০১৭ সালের চতুর্থাংশে এসে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে, যা তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্বের হার ১৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে। ধারাবাহিকভাবে ঝুঁকি মোকাবিলা করে আসা চীনও ২০১৭ সালে তাদের ৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করবে বলে মনে করা হচ্ছে। এমনকি তেলের কম মূল্য এবং ইউক্রেনজুড়ে নিষেধাজ্ঞার কারণে কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক মন্দায় থাকা রাশিয়াও সামান্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। 

অক্টোবরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস বাড়ার পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে।’ তবে মন্দার কারণে যে ক্ষতি হয়েছে তা এখনও মেটানো যায়নি বলেও সতর্ক করেছে আইএমএফ। সংস্থাটি আভাস দিয়েছিল, ২০১৭ সালে বিশ্বের অর্থনৈতিক গড় প্রবৃদ্ধির মাত্রা হবে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৬ সালের চেয়ে এই লক্ষ্যমাত্রা ০ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি ছিল। ২০১৭ সালে বিশ্বের ধনকুবেররা আগের চেয়ে আরও বেশি সম্পদের মালিক হয়েছেন। শীর্ষস্থানীয় ৫০০ ধনীর সম্পদের পরিমাণ হিসেব করে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ বলছে, ২০১৭ সালে তারা সবাই মিলে আগের চেয়ে ১ ট্রিলিয়ন (১ লাখ কোটি) ডলার বেশি ধনী হয়েছেন। আগের বছরের তুলনায় এর পরিমাণ চার গুণ বেশি। ব্লুমবার্গ বিলিওনিয়ার্স ইনডেক্স অনুযায়ী, বিশ্বের ধনী শ্রেণির সম্পদের পরিমাণ ২৩ শতাংশ বেড়েছে। তবে এমএসসিআই ওয়ার্ল্ড ইনডেক্স এবং স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর’স ফাইভ হান্ড্রেড ইনডেক্স অনুযায়ী এই বৃদ্ধির পরিমাণ ২০ শতাংশ।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতীকী ছবি
থামেনি 
দুর্ভিক্ষের অশনি সংকেত

বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি ও সম্পদশালীদের সম্পদ আরও বাড়লেও দুর্ভিক্ষ কড়া নাড়ছে যুদ্ধ ও সংঘাত কবলিত দেশগুলোতে। কোথাও কোথাও আবার দুর্ভিক্ষের করাঘাত শুরুও হয়ে গেছে। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ সুদানের কিছু অংশে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়। সরকারি ও জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ১ লাখ লোক ক্ষুধাকষ্টে ভুগছে। আরও দশ লাখ লোক দুর্ভিক্ষের শিকার হওয়ার মুখে রয়েছে। গৃহযুদ্ধ ও অর্থনৈতিক ধসকে এ দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী করা হয় সে সময়। মার্চে সোমালিয়ায় দুর্ভিক্ষ এড়াতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। ওই সময় জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়, আফ্রিকার তিন দেশ দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া ও নাইজেরিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেন ভয়াবহ খাদ্য সংকটের মুখে পড়েছে। বলা হয়, ওই চার দেশের তিন কোটি মানুষ রয়েছেন ভয়াবহ খাদ্য সংকটে। দুর্ভিক্ষজনিত মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছেন এক কোটি মানুষ। 

উল্লেখযোগ্য চুক্তি

২০১৭ সালের জুলাইয়ে পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণে সম্মত হয় জাতিসংঘের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দেশ। পারমাণবিক যুদ্ধ এড়াতে ৭ দশকের প্রচেষ্টার পর জাতিসংঘে ওই নতুন বৈশ্বিক চুক্তি হয়। জাতিসংঘের ১৯২ টি সদস্যদেশের মধ্যকার দুই-তৃতীয়াংশ দেশের আলোচকরা ১০ পাতার চুক্তি চূড়ান্ত করেন। চুক্তির পক্ষে পড়ে ১২২ ভোট। একটি ভোট পড়েছে বিপক্ষে এবং সিঙ্গাপুর ভোটদানে বিরত ছিল। ভোটে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিশ্বের ৯ টি পারমাণবিক অস্ত্র সমৃদ্ধ দেশের কোনওটিই ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স এ চুক্তি নাকচ করে বলেছে, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলোর হুমকির বিষয় বিবেচনায় নিলে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার দিক দিয়ে এ চুক্তি একবারেই বাস্তবতা বিবর্জিত।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং দায়ী দেশগুলোর ভ্রূক্ষেপহীনতা

২০১৭ সালে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয়নি। বিশ্ব ক্রমাগত উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে। সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাসাগর ও বায়ুমণ্ডল সংক্রান্ত প্রশাসনের (এনওএএ)  পক্ষ থেকে বলা হয়, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উষ্ণতার বছর হিসেবে রেকর্ড গড়েছে ২০১৭ সাল। এর আগে ২০১৬ সাল ছিল বিশ্বের উষ্ণতম বছর। দশটি উষ্ণতম বছরের মধ্যে বাকি আটটিরও রেকর্ড হয়েছে ১৯৯৮ সালের পর। তবে তা সত্ত্বেও বিশ্বকে ২০১৭ সালে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি। উল্টো এই বছরের জুনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।

এই বছর বেশ কয়েকটি ভয়াবহ হারিকেন, ভূমিকম্প এবং দাবানলসহ বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। যুক্তরাষ্ট্রও  বাদ যায়নি। অথচ এরপরও প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন ট্রাম্প।

ইয়েমেনের শিশু
গুরুত্বপূর্ণ
আবিষ্কার ও মহাকাশে সাফল্য

এই বছর এইচআইভি চিকিৎসার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সফলতার দাবি করেন বিজ্ঞানীরা। জুনে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০ বছর বয়সী যেসব তরুণ ২০১০ সাল থেকে এন্টিরিট্রোভাইরাল থেরাপি নিচ্ছেন তারা ১৯৯৬ সালে একই চিকিৎসার আওতায় আসা ব্যক্তিদের চেয়ে ১০ বছর বেশি বাঁচতে পারবেন। যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক এই দাবি করেন।

২০১৭ সালে ক্যান্সার চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি এনেছেন কিউবার একদল চিকিৎসাবিজ্ঞানী। এই বছরের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চিকিৎসা বিষয়ক সাময়িকী ডব্লিউমেড খবর দেয়, ক্যানসার প্রতিরোধে কিউবান বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত সেই টিকা মানবদেহে প্রয়োগ করে ভালো রকমের সাফল্য পাওয়া গেছে। গবেষক ছাড়াও চিকিৎসকরা আশাবাদী ক্যান্সারের অগ্রসর স্তরে এটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। আবিষ্কারক দলের বিজ্ঞানীরা অবশ্য তাদের উদ্ভাবনকে বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার ভেতরকার এক চলমান পদক্ষেপ হিসেবেই দেখছেন। তাই বড় ধরনের অগ্রগতির কথা বললেও চূড়ান্ত কোনও সাফল্য দাবি করেননি তারা।

ফ্যালকন নাইন রকেট
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ক্যাসিনি হাইজিনস প্রথম কোনও মহাকাশ যান হিসেবে শনি গ্রহে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।

২০১৭ সালে পূর্বে ব্যবহারকৃত রকেটকে আবারও সফলভাবে মহাকাশে পাঠাতে সক্ষম হয় যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি মহাকাশ সংস্থা স্পেসএক্স। ফ্যালকন নাইন নামের পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেটটি মহাকাশে একটি স্যাটেলাইট পৌঁছে দেওয়ার পর সফলভাবে আটলান্টিক মহাসাগরে একটি ড্রোন জাহাজে অবতরণ করে।

ক্ষমতাশালীদের কেলেঙ্কারি ও নজরদারির তথ্য ফাঁস

পানামা পেপারসের ধারাবাহিকতায় এই বছর প্যারাডাইজ পেপারস নামের নথির মধ্য দিয়ে ক্ষমতাশালীদের আর্থিক কেলেঙ্কারির খবর ফাঁস করা হয়েছে। পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি ফাঁস করে বিশ্বজুড়ে হৈচৈ ফেলে দেওয়া আইসিআইজি বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সহযোগিতা করে প্যারাডাইজ পেপারসও ফাঁস করেছে। এই কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর নাম। প্যারাডাইজ পেপারসে মূলত ফাঁস হয়েছে কর থেকে বাঁচার জন্য অন্যান্য দেশে বিনিয়োগ করা ব্যক্তিদের আর্থিক কেলেঙ্কারি। কর দিতে হয় না কিংবা খুবই নিম্নহারে কর দেওয়া যায় এমন দেশে বিনিয়োগ করে আর্থিকভাবে লাভবান হতে চান তারা।

অন্যান্য বছরের মতো এই বছরও গোপন নজরদারির খবর ফাঁস করেছে উইকিলিকস। বছরের পর বছর ধরে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে গোপনে গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়ে আসছে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। এজন্য তারা যেসব সফটওয়্যার ও পদ্ধতি ব্যবহার করে মার্চে সেই পদ্ধতি ও সফটওয়্যারগুলো উন্মুক্ত করে দেয় উইকিলিকস। সংবাদমাধ্যমটির প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বলেছেন, এটা সিআইএ’র ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ফাঁসের ঘটনা।