ইরানি বিক্ষোভ কি কেবলই পশ্চিমা প্রচারণা?

ইরানে গত বছরে শুরু হওয়া ২৮ ডিসেম্বরের বিক্ষোভ এরইমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। তেহরান এই বিক্ষোভে সৌদি আরবসহ যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের মতো পশ্চিমা দেশগুলোর ইন্ধন খোঁজার চেষ্টা করলেও এই অভিযোগ মানতে নারাজ রাজনীতি বিশ্লেষকরা। বিক্ষোভের নেপথ্যে অর্থনৈতিক কারণকেই বড় করে দেখছে তারা। বিশ্লেষকদের বক্তব্যের সমর্থন মিলেছে বিক্ষোভকারীদের স্লোগান আর তৎপরতাতেও। জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয় আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুরু হওয়া বিক্ষোভটি এরইমধ্যে রূপান্তরিত হয়েছে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক সমাবেশে। সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবতার ফারাকের কারণে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিই হয়ে উঠেছেন ক্ষোভের লক্ষ্যবস্তু। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর প্রথমবারের মতো উত্তাল স্লোগান উঠেছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ঘুষ-দূর্নীতি কিংবা হুথি-হিজবুল্লাহ-ফিলিস্তিনকে সমর্থনের বিরুদ্ধে। দেশটির অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থা আর পররাষ্ট্রনীতিকে এই অর্থনৈতিক দুর্গতির নেপথ্য কারণ ভাবতে শুরু করেছে দেশটির সাধারণ মানুষ।
ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ

মৌলিক খাদ্য দ্রব্যগুলোর দাম বৃদ্ধি এবং নতুন বছরের বাজেটে জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধির সরকারি প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ২৮ ডিসেম্বর ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর মাশহাদে বিক্ষোভ শুরু হয়। পরে তা তেহরান ও অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৯ সালে ইরানে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমদিনেজাদের পুনর্নির্বাচিত হওয়াকে কেন্দ্র করে হওয়া বিক্ষোভের চেয়েও এইবারের ঘটনাকে বড় বলে মনে করা হচ্ছে। বিক্ষোভটি এরইমধ্যে রাজনৈতিক মাত্রা পেয়েছে। শ্লোগান উঠেছে ইরানের শাসন ক্ষমতায় থাকা ধর্মীয় ও সরকারি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। সরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা পুলিশ স্টেশনের মতো জায়গাগুলোকে প্রতিবাদের কেন্দ্র বানিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। ইসলামী রেভ্যুলুশনারি গার্ডস কর্পোরেশন- আইআরজিসিকে দমন ও নিপীড়নমূলক ভূমিকার কারণে দুষছে বিক্ষোভকারীরা। স্বৈরাচারের পতন চাই কিংবা রুহানি নিপাত যাক; এমন শ্লোগানে প্রকম্পিত হচ্ছে তেহরানসহ সারাদেশ। ইরানে ধর্মীয় প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতাই চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ বলে বিবেচিত হন। সেই ইরানে ‘খোমেনি নিপাত যাক’ বলে শ্লোগান তুলেছে জনতা। পুড়ছে খোমেনি আর আইআরজিসি কমান্ডার কাশেম সোলায়মানির ছবি।

কী চাইছেন বিক্ষোভকারীরা

ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ইরানি নাগরিকদের অনেকে উচ্চ মজুরির দাবি জানাচ্ছেন এবং ঘুষের অবসান চাইছেন। অনেকে আবার মধ্যপ্রাচ্যে ইরানি পররাষ্ট্রনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। তাদের দাবি, এই পররাষ্ট্রনীতির আওতায় সিরিয়া ও ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সৌদি আরবের সঙ্গে আধিপত্যের লড়াইয়ে নেমেছে তেহরান। ফিলিস্তিনি এবং লেবাননের শিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদানের বিষয়টিও ইরানিদের ক্ষুব্ধ করেছে। জনগণ চাইছে, এর বদলে সরকার অভ্যন্তরীণ সংকটের দিকে নজর দিক।

ইরানিদের বিক্ষোভ

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিক্ষোভে উচ্চারিত বিপুল সংখ্যক স্লোগানের মধ্য দিয়ে বোঝা যায় বিক্ষোভে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণি ভিন্ন ভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে শামিল হয়েছেন। এইবারের বিক্ষোভটি ২০০৯ সালের বিক্ষোভের চেয়ে খানিকটা আলাদা। এইবার নির্দিষ্ট কোনও নেতা নেই। বিক্ষোভ অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্তভাবে হচ্ছে। কেউ কেউ রাজতন্ত্রের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছেন। বলছেন, ‘রেজা শাহ, আপনার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।’ রেজা শাহ পাহলভী হলেন, ইরানের বাদশাহ, যিনি ১৯২৫ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত দেশটি শাসন করেছেন। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রথম নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির হাতে পাহলভী পরিবারতন্ত্রের পতন হয়েছিল। এছাড়া ইরানের পররাষ্ট্রনীতির সমালোচনা করে বিক্ষোভে স্লোগান দেওয়া হচ্ছে- ‘ফরগেট প্যালেস্টাইন’ ‘নট গাজা, নট লেবানন, মাই লাইফ ফর ইরান।’

কেন এই হতাশা?

২০১৭ সালের মে মাসে ইরানের সংস্কারপন্থীদের দলের হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন হাসান রুহানি। ২০১৫ সালে ছয় শক্তিধর দেশের সঙ্গে ইরানের ঐতিহাসিক পারমাণবিক চুক্তির পর এটিই দেশটিতে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচন। চুক্তির আওতায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিলের বিনিময়ে পারমাণবিক তৎপরতা সীমিত করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছিল ইরান। অনেকে তখন আশা করেছিলেন, চুক্তির পর অনেক আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে, তাতে দেশটির অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়নজনিত সংগ্রাম কমবে। তবে এখন পর্যন্ত জনগণ প্রত্যাশিত সুবিধা পায়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই কারণেই লোকজন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে।

ইরানি বিক্ষোভ

বেলজিয়ামভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরানবিষয়ক প্রকল্প পরিচালক আলি ভায়েজ। পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে ইরানের সঙ্গে ছয় শক্তিধর দেশের আলোচনা চলার সময় সব পক্ষের সঙ্গেই কাজ করেছেন তিনি। ভায়েজ মনে করেন, পারমাণবিক চুক্তির কারণে জনগণ যে ধরনের ফলাফল প্রত্যাশা করেছিলেন তা পূরণ হয়নি। আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘সরকার জনগণকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় তাদের প্রত্যাশা বেড়ে গিয়েছিল।’ ভায়েজ বলেন, ‘রুহানি প্রতিশ্রুতি বেশি দিয়েছেন, পূরণ করেছেন কম।’ তার মতে, তেলের মূল্য কমে যাওয়া এবং পারমাণবিক চুক্তির প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্র কতটা পূরণ করতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হওয়ায় ইরানি অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ছে।

আলি ভায়েজের মতামত প্রতিধ্বনিত হয়েছে ইরানের রাজনীতি বিশ্লেষক মোহাম্মদ আলি শাবানির কণ্ঠেও। বিক্ষোভ সম্পর্কে নিজের অবস্থান জানাতে আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘এটি উচ্চাভিলাষী প্রত্যাশার ব্যাপার। সেকারণেই বিপদটা এসেছে। পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে রুহানি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাতে লোকজনের উন্নত জীবন যাপনের প্রত্যাশা বেড়ে গিয়েছিল। চরম দারিদ্র্যের কারণে যে লোকজন রাস্তায় নেমে এসেছে তা নয়। জনগণের মনে হচ্ছে, আমাদের এখন যা আছে তার চেয়ে আমাদের প্রয়োজন বেশি, যা কিছু ঘটছে তার চেয়ে বেশি কিছু আমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। আমরা যেরকম চাকরির প্রত্যাশা করছিলাম তা আমাদের হাতে নেই।’

গৃহবন্দি থাকা বিরোধী দলীয় নেতা মেহেদি কারুবির ছেলে মোহাম্মদ তাগি কারুবির দাবি, ‘বিক্ষোভ উসকে দেওয়ার জন্য বিদেশি শক্তিগুলোকে দোষারোপের বদলে এস্টাবলিশমেন্টকে স্বীকার করতে হবে যে ইরানের অভ্যন্তরে বিক্ষোভ হওয়ার ভিত্তি আছে।’ রুহানির সরকারও অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে জনগণের উদ্বেগের বিষয়টি স্বীকার করেছে। তবে বিশৃঙ্খল আচরণ না করার জন্য জনগণকে সতর্ক করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট রুহানি রবিবার বলেছেন, ইরানি নাগরিকদের সরকারবিরোধী প্রতিবাদের অধিকার রয়েছে; তবে নিরাপত্তাকে বিপন্ন করার অধিকার কারও নেই। ইরানে বিদ্যমান সংকটের কথা স্বীকার করে রুহানি বলেন, ‘সমস্যা সমাধান করা হবে। তবে সংঘর্ষ-ভাঙচুর সহ্য করা হবে না।’