ইরানি বন্দরে ‘ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ’, মোদির নজর আফগানিস্তানে

অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলে ছাবাহার বন্দর উন্নয়নে ২০১৬ সালেই একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সম্পন্ন করে ভারত-ইরান-আফগানিস্তান। ওই চুক্তিতে দিল্লির স্বার্থ ছিল আফগানিস্তানে প্রবেশ সহজতর করা। এবার হাসান রুহানির সফরে ইরানের কাছে ‘শহীদ বেহেস্তি বন্দর’র ফেস-১ এর ইজারা পেল ভারত।  এ সংক্রান্ত এক সমঝোতা অনুযায়ী ওই বন্দরে পূর্ণ ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ থাকবে আগামি দেড় বছর। সমঝোতা স্বাক্ষরের দিনে মোদি আফগানিস্তানকে জঙ্গিমুক্ত ও নিরাপদ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেন। কূটনীতি-বিষয়ক সাময়িকী ডিপ্লোম্যাটের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ছাবাহার চুক্তি আফগানিস্তানে ভারতের অবস্থান শক্তিশালী করবে। তবে দিল্লি-তেহরান সম্পর্কের জটিলতা চুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলে আশঙ্কাও জানানো হয়েছে ওই বিশ্লেষণে।
শনিবার ভারত-ইরানের মধ্যে ছাপাহারসহ ৯ খাতে সমঝোতা হয়

আফগানিস্তানের কাবুল সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থক ভারত। ২০০১ সালে তালেবান সরকারের পতনের পর আফগানিস্তানে দুইশ কোটি ডলারের বেশি  খরচ করেছে দেশটি। এরমধ্যে ২০১৬ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য একশ কোটি ডলার আর্থিক সহায়তা দেয় ভারত। আঞ্চলিক প্রভাব বাড়ানোর লক্ষ্যে দেশটিতে সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নিজেদের উপস্থিতি আরও বাড়াতে চায় ভারত। সেই উদ্দেশ্যেই ২০১৬ সালে ইরানি বন্দর ছাবাহারের উন্নয়নে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে ভারত।

২০১৬ সালে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী, ছাবাহার বন্দরের উন্নয়নে ইরানকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছিল ভারত। পাকিস্তানকে এড়িয়ে আফগানিস্তানে সমুদ্র পথে যোগাযোগ সহজতর করতে ভারত ও ইরান সম্প্রতি ছাবাহার বন্দরে কার্যক্রমও শুরু করেছে। এবার ইরান অ্যান্ড ইন্ডিয়া পোর্টস গ্লোবাল লিমিটেড নামে অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য ছাবাহারের ‘শহীদ বেহেস্তি বন্দর’র ফেস-১ এর ইজারা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে তেহরান ও দিল্লির মধ্যে। এর মাধ্যমে দেড় বছরের জন্য ইরান তাদের ছাবাহার বন্দরকে বহুমুখী ব্যবহারের জন্য ভারতকে ইজারা দিতে সম্মত হয়েছে। স্বাক্ষরিত সমঝোতা অনুযায়ী, ভারতের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে এটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে। চুক্তিটিতে ভারতের পক্ষে নৌ-পরিবহণ মন্ত্রী নিতিন গাদকারি ও ইরানের পক্ষে সড়ক ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রী ড. আব্বাস আখুন্দি স্বাক্ষর করেছেন। 

ছাপাহার বন্দর প্রজেক্টআফগানিস্তানে পণ্য রফতানির জন্য এখনও পাকিস্তানের বন্দর ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল ভারত। ২০১৭ সালের আগস্টে ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস খবর দিয়েছিল, ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে ছাবাহার বন্দরের কার্যক্রম শুরু হবে। এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে তারা জানিয়েছিল, বন্দরটিতে ভারতের কার্যক্রম শুরু হলে আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ পাকিস্তানকে এড়িয়ে ইরানের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ সৃষ্টি করতে পারবে দিল্লি। তাই ইরানের পাশাপাশি আফগানিস্তানের সঙ্গেও ভারতীয় বাণিজ্যের সুযোগ প্রসারিত হবে বন্দরটি চালু হলে। বিপরীতে আফগানিস্তানও পাকিস্তানের ওপর নির্ভশীলতা কমাতে পারবে। সেই সময়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, আফগানিস্তানের পাশাপাশি মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে লক্ষ্য করেও ভারত এই চুক্তি করছে।

নববর্ষের টুইট বার্তায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে মদদের অভিযোগ তুলতে গিয়ে আফগানিস্তানের প্রসঙ্গ টেনেছিলেন। জঙ্গিদের জন্য পাকিস্তান নিভৃত আবাস গড়ে তোলার সুযোগ করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ তোলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। স্থগিত করা হয় নিরাপত্তা সহযোগিতা। আফগান জঙ্গিরা পাকিস্তানে মদদ পাচ্ছে বলেও সে সময় যুক্তরাষ্ট্র ও আফগানিস্তানের তরফ থেকে কাছাকাছি সময়ে অভিযোগ করা হয়। সেই পাকিস্তানকে এড়িয়েই ছাবাহার বন্দরকে বাণিজ্য সম্প্রসারণের হাতিয়ার করার ঘোষণা এসেছে মোদি-রুহানির পক্ষ থেকে।

মানচিত্রে ছাপাহার

চুক্তি স্বাক্ষর শেষে যৌথ সংবাদ মোদি বা রুহানির কেউই জঙ্গিবিরোধী যুদ্ধে আফগানিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ বা সরাসরি আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে পাকিস্তানকে দায়ী করে কিছু বলেননি। এমনকী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তানের জঙ্গিদের সহায়তা করার অভিযোগ থাকলেও কেউই দেশটির নাম উল্লেখ করেনি। তবে সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আফগানিস্তান বিষয়ে বলেন, অভিন্ন স্বার্থের কারণে আমরা (ভারত ও ইরান) সন্ত্রাসীদের বিস্তার রোধে বদ্ধপরিকর। আন্তর্জাতিকভাবে সংগঠিত বিভিন্ন গোষ্ঠী সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা, অবৈধ মাদক পাচার, সাইবার ক্রাইমসহ বিভিন্ন অপরাধ ছড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আমরা আমাদের অঞ্চল ও বিশ্বকে সন্ত্রাসবাদ মুক্ত হিসেবে দেখতে চাই।

ডিপ্লোম্যাটের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানে বাণিজ্য বাড়াতে ভারত ইরানে তার উপস্থিতিকে কাজে লাগিয়েছে। এর মাধ্যমে কাবুলও পাকিস্তানের বিকল্প হিসেবে ভারতকে পাচ্ছে। আর সেখানে ভারতের অবস্থান আরও শক্তিশালী হচ্ছে। ইরান ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কজনিত জটিলতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ওই বিশ্লেষণে চুক্তি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ পেয়েছে। 
ছাপাহার বন্দরের কম্পিউটার ইমেজ

ডিপ্লোম্যাটের ওই বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, ভারতীয় চর কুলভূষণ জাদব এখন পাকিস্তানে মৃত্যুর মুখে রয়েছে। তাকে ইরান থেকে অপহরণ করা হয়েছিল। এই ব্যাপারটা শুধুমাত্র ভারত-পাকিস্তানের নিজস্ব বিষয় নয়। এটা ছাড়া ইরানে আল কায়েদার প্রবেশাধিকার ও ওসামা বিন লাদেনের পরিবারকে আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পর দেশটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠছে। সন্ত্রাসবাদের আন্তর্জাতিক ধারণায় ইরানের জন্য বিষয়গুলো অস্বস্তিকর। পাকিস্তানের সঙ্গে নিজস্ব সমস্যাগুলোর জন্য ভারত কোনওভাবেই ইরানকে লাগাতার টেনে আনতে পারবে না। তবে আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে ইরানকে তারা কাজে লাগাতে সক্ষম। কারণ দেশটি ভৌগলিকভাবে পাকিস্তানের প্রতিবেশি। আর দেশটির সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের সম্পর্ক রয়েছে।