প্রভাব বিস্তার নিয়ে চীন-ভারতের প্রতিযোগিতায় শ্রীলঙ্কায় ক্ষোভ

ভারত, শ্রীলঙ্কা ও চীনদক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে প্রভাব বাড়াতে বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে শত শত কোটি ডলার ব্যয় করছে চীন ও ভারত। তবে দিন দিন এসব প্রকল্প নিয়ে সমালোচনা বাড়ছে। এরই মধ্যে মিয়ানমার, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ খাতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছে চীন। তবে তাদের আলোচিত প্রকল্পগুলো রাজনৈতিক প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। এবার শ্রীলঙ্কার বিতর্কিত মাত্তালা বিমানবন্দরের উন্নয়ন কার্যক্রমে যুক্ত হয়ে একই ধরনের প্রতিরোধের মুখে পড়তে যাচ্ছে ভারত। আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের অজুহাতে শ্রীলঙ্কার জাতীয় সম্পদ চীন ও ভারতকে তুলে দেওয়া হচ্ছে বলে সমালোচনা করে আসছেন দেশটির বিরোধী রাজনীতিকরা। এমনকি পর্যবেক্ষকরাও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন।
চীনের অর্থায়নে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর নির্মাণ ও ১৫০ কোটি ডলারের উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের উচ্চাভিলাষী স্বপ্নের অংশ হিসেবে এই বন্দর নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া বন্দরটির পাশে মাত্তালায় নতুন বিমানবন্দর ও একটি স্টেডিয়াম নির্মাণ করেছে চীন। এসব অবকাঠামোগুলোকে মূল শহরের সঙ্গে যুক্ত করতে চমৎকার সড়কও নির্মাণ করা হয়েছে। বিভিন্ন চীনা কোম্পানি এসব নির্মাণ করছে।
এসব প্রকল্পের তীব্র বিরোধিতা রয়েছে খোদ শ্রীলঙ্কাতেই। কারণ, এসব প্রকল্পের চুক্তি অনুযায়ী, শ্রীলঙ্কা ঋণ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় চীনকে সার্বভৌম নিশ্চয়তা দিয়েছে। ঋণ পরিশোধ করতে শ্রীলঙ্কা ব্যর্থ হলে অবকাঠামোগুলোর মালিকানা পাবে চীন। কিন্তু সমালোচনা এড়াতে চুক্তির সময় বিষয়টি প্রকাশ করা হয়নি।
চীনের কাছে শ্রীলঙ্কার দেনা বাড়তে বাড়তে এখন ৮০০ কোটি ডলারে ঠেকেছে। এই ঋণের চড়া সুদ পরিশোধ করাই বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনার সরকারের পক্ষে অনেক কঠিন। এর বড় কারণ হলো—হাম্বানটোটা বন্দরটি থেকে আশানুরূপ আয় হচ্ছে না। বেশিরভাগ জাহাজ হাম্বানটোটার পরিবর্তে কলম্বো বন্দর ব্যবহার করছে। একইভাবে মাত্তালা বিমানবন্দর থেকে সপ্তাহে দুবাইগামী মাত্র একটি ফ্লাইট চলাচল করছে। ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ পরিকল্পনার আওতায় এসব অবকাঠামো নির্মাণ করছে চীন। আর কূটনৈতিকপাড়ার গুঞ্জন, বিকল্প থাকা পর্যন্ত চীনের অবকাঠামো ব্যবহার করতে আগ্রহী নয় পশ্চিমা কোম্পানিগুলো।
এ কারণে হাম্বানটোটা বন্দরের ৮০ শতাংশ মালিকানা চীনের কাছে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। কারণ, চুক্তি অনুযায়ীই এই মালিকানা পাবে চীন। একইসঙ্গে বন্দর এলাকায় প্রায় ১৫ হাজার একর জমিও ইজারা নিয়েছে দেশটি। সেখানে চীনা অর্থায়নে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
ভারত, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে আসছে, বন্দর নির্মাণের অজুহাতে ভারত মহাসাগরে সামরিক প্রভাব বিস্তারের জন্য হাম্বানটোটায় নৌঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা করছে চীন। তবে চীনের পক্ষ থেকে এ অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। এদিকে বন্দরটির প্রশাসনিক ক্ষমতা চীনকে দেওয়ার পর তারা সেখানে জনসাধারণের প্রবেশ সীমিত করে ফেলতে পারবে। তখন যা খুশি তাই করা থেকে তাদের কেউ ঠেকাতে পারবে না।
আফ্রিকার জিবুতি ও পাকিস্তানের গদারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ভারত মহাসাগরে কৌশলগত বন্দর হিসেবে হাম্বানটোটাকে ব্যবহারের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে চীন। তারপরও সেখানে ঢুকে পড়েছে ভারত। মাত্তালা বিমানবন্দরের উন্নয়নের জন্য প্রস্তাব দিয়েছে দেশটি। ভারতের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তেমন কোনও বিতর্কও হয়নি। তবে সেখানে ভারতের অবস্থানের কারণটিও অস্পষ্ট।
শ্রীলঙ্কায় প্রাথমিকভাবে ২৮ কোটি মার্কিন ডলারের মতো বিনিয়োগ করছে ভারত। কূটনীতিকরা বলছেন, শ্রীলঙ্কার কাছ থেকে চীনের ঋণ কিনে নিচ্ছে ভারত। দেশটি প্রথমে মাত্তালায় একটি বিমান একাডেমি নির্মাণ করবে। তবে চীন এরই মধ্যে মাত্তালার সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য ২৫ কোটি ডলার খরচ করেছে।
এ পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ বিশ্লেষকই আঞ্চলিক উন্নয়নে দুই বড় শক্তির মুখোমুখি অবস্থানকে বিপজ্জনক মনে করছেন। চীন সেখানে নৌঘাঁটি নির্মাণের খবরের ব্যাপারে কখনই জোরালো প্রতিবাদ করেনি। এই কারণ দেখিয়ে হাম্বানটোটায় চীনের জাহাজসহ অন্যান্য নৌযানের গতিবিধি কাছ থেকে নজরদারি করতে চায় ভারত। এজন্যই এমন অলাভজনক বিমানবন্দরের সঙ্গে যুক্ত হতে আগ্রহ দেখাচ্ছে তারা।
শ্রীলঙ্কায় এমন ভারত-চীনের উপস্থিতি স্থানীয় রাজনীতিতেও উত্তেজনা বাড়িয়েছে। বিরোধীদলীয় রাজনীতিকরা এসব প্রকল্পের বিরোধিতা করছেন। এমন বিরোধিতা শ্রীলঙ্কাসহ এই দুই দেশের স্বার্থও নষ্ট করতে পারে। শ্রীলঙ্কার পর্যবেক্ষকদের মতে, দীর্ঘমেয়াদে এমন উত্তেজনা ও দুই দেশের উপস্থিতি উদ্বেগের মূল কারণ। ত্রিপাক্ষিক সম্পর্কে কখনও ফাটল দেখা দিলে তার পরিণতি ভোগ করতে হবে শ্রীলঙ্কাকে। তবে এসব আশঙ্কার বিষয়ে ভারত এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। ফলে তাতে শ্রীলঙ্কানদের মধ্যে উদ্বেগ কমেনি, বরং বেড়েছে।
শ্রীলঙ্কার বর্ষীয়ান রাজনীতিক ও বিরোধীদলীয় এমপি দুলাস আজাহাপ্পেরুনা সাংবাদিকদের বলেন, উন্নয়নের নামে চীন ও ভারতের কাছে দেশের জাতীয় সম্পদ তুলে দেওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এর পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে পারে। সম্প্রতি হাম্বানটোটা বন্দরের বাইরে বিক্ষোভ করার সময় বিরোধীদলীয় তিন এমপিকে গ্রেফতারও করা হয়।
চীনের উচ্চাভিলাষী ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড পরিকল্পনার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি এড়িয়ে চলতে ভারত সরকারকেও উপদেশ দিয়েছেন সে দেশের প্রভাবশালী বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আঞ্চলিক সহযোগিতা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভারতকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মতো উইন-উইন মডেল অনুসরণ করতে হবে, যেন উভয়পক্ষই ভাবে তারা লাভবান হয়েছেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে কার্যকর পরিকল্পনা ও সংলাপের মাধ্যমে সড়ক ও রেলপথ ট্রানজিট চুক্তি এবং নৌচলাচলে সহায়তা বাড়িয়েছে ভারত। এর জন্য বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়নও করতে হয়েছে। বিনিময়ে বাংলাদেশ নেপাল ও ভুটানসহ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলোর সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করতে পারছে। এতে জাতীয় আয় ও বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং জ্বালানি ও সময়ের সাশ্রয়সহ দুই দেশেই নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
আরও পড়ুন-
নেতানিয়াহু একজন সন্ত্রাসী ও দখলদার: এরদোয়ান
কাশ্মিরে ভারতীয় বাহিনীর অভিযানে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৯