আইএস-মুক্ত মসুলে স্বস্তির ঈদ, ঐতিহ্যগত খেলনা যুদ্ধ সরঞ্জামকে ‘না’

ইরাকের মসুলে ঈদ উদযাপনের সঙ্গে ঐতিহ্যগতভাবে জড়িয়ে ছিল শিশুদের কৃত্রিম যুদ্ধবাজি। ঈদ আনন্দের অংশ হিসেবে আতশবাজি কিংবা খেলনা বন্দুকে দাদা-দাদী কিংবা বোনদের ভয় দেখানোর উৎসবে মেতে উঠতো ইরাকের কিশোররা। তবে তিন বছরের আইএস-নিয়ন্ত্রণ পাল্টে দিয়েছে সেখানকার পরিস্থিতি। আইএসের কর্তৃত্বের বিগত দিনগুলোতে মারণাস্ত্রকে দৈনন্দিন যাপনের অংশ হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল মসুলবাসী। বিদ্যালয়ের গণিত শিক্ষাতেও তাদের পাঠ নিতো বুলেট আর গ্রেনেড গুনে গুনে। সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিতে তরুণদের জন্য অপরিহার্য করে তোলা হয়েছিল সামরিক প্রশিক্ষণ। আইএস-মুক্ত মসুলে তাই, যুদ্ধ সরঞ্জাম যেন এক আতঙ্কের নাম। ‘খেলনা যুদ্ধ সরঞ্জাম’ও তাদের মনে করিয়ে দেয় ক’দিন আগের আইএস নিয়ন্ত্রণাধীন বাস্তবতার স্মৃতি।  ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক ছবিতে সেখানকার কিছু শিশুকে ঐতিহ্যগত খেলনা বন্দুক নিয়ে ঈদ উদযাপন করতে দেখা গেলেও ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে,  ঈদ উদযাপনের ঐতিহ্য থেকে ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’কে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেখানকার অনেক মানুষ। দুই সংবাদমাধ্যমই জানিয়েছে, আইএসমুক্ত মসুলে অপেক্ষাকৃত স্বস্তিজনক পরিবেশে ঈদ উদযাপন করছে সেখানকার জনসাধারণ।
noname

২০১৪ সালের জুন মাসে ইরাক সরকারের হাত থেকে মসুলের নিয়ন্ত্রণ নিজেরে হাতে নিতে সমর্থ হয় আইএস। সে সময় সিরিয়ার আলেপ্পোর পূর্বাঞ্চলের বিশাল এলাকা আর ইরাকের মধ্যাঞ্চলীয় বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে স্বঘোষিত খিলাফতের ঘোষণা দেন আইএস নেতা আবু বকর আল-বাগদাদি। খিলাফতের রাজধানী বানানো হয় সিরিয়ার রাকা শহরকে। এর মধ্য দিয়ে গঠিত হয় ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ত বা আইএসআইএল,যা সংক্ষেপে আইএস নামে পরিচিতি পায়। মার্কিনসমর্থিত ইরাকি বাহিনী মসুল পুনর্দখলে অভিযান শুরু করে। ২০১৭ সালের জুনে আইএস’র কাছ থেকে মসুল পুনরুদ্ধার করে ইরাকি সেনাবাহিনী।  

মাত্র এক বছর আগে আইএসের কাছ থেকে ইরাকের সেনাবাহিনী মসুল শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় যুদ্ধ এখনও সেখানে এক বাস্তব আতঙ্কের নাম। খেলনা যুদ্ধসামগ্রী কিংবা যুদ্ধের খেলাও সেখানকার মানুষকের ফিরিয়ে নিচ্ছে আইএস-এর অধীনে থাকার সময়কার বিভীষিকাময় মুহূর্তগুলোতে। তবে সেইসব দিনের কথা কিছুতেই মনে করতে চান না স্থানীয়রা। যুদ্ধের বিভীষিকাময় স্মৃতিকে পেছনে রেখে নতুন পথের অনুসন্ধান করছে মসুলবাসী। তাই ঈদের সময় প্রতিবারের মতো শিশুদের খেলনা যুদ্ধসামগ্রী কিনে দিচ্ছেন না বাবা-মা।

ঐতিহ্যগতভাবেই ঈদের সময় খেলনা পিস্তলসহ বিভিন্ন যুদ্ধসামগ্রী বিক্রি হয় ইরাকে। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবারের মতো এবারও ঐতিহাসিক নবী ইউনিস মার্কেটে এখনও খেলনা অস্ত্র আর আতশবাজি বিক্রি হচ্ছে।তবে এ নিয়ে উদ্বিগ্ন এক স্থানীয় বাসিন্দা দোকান থেকে সব খেলনা অস্ত্র সরিয়ে ফেলার চিন্তা করেছেন। সবগুলো খেলনা অস্ত্র নিজে কিনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে শিশুদের যুদ্ধ সামগ্রীর বাইরে রাখার পরিকল্পনা করেছেন তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি এএফপিকে বলেন, ‘এর মধ্য দিয়ে আমি বিক্রেতাদের কাছে বার্তা পাঠানোর চেষ্টা করছি, যেন তারা তাদের দোকানে এসব খেলনা না রাখে।’ শুক্রবার (১৫ জুন) মসুল শহরজুড়ে ঈদের নামাজে দেওয়া বয়ানে ব্যবসায়ীদের প্রতি বিকল্প উপহার বিক্রির আহ্বান জানানো হয়। ওই ব্যক্তির আশা, সরকারিভাবেও এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। 

ইরাকে সরকারি বাহিনী ও আইএসের সংঘর্ষে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে মসুলের বিপুল পরিমাণ সম্পদ। প্রথমবারের মতো ৫০ বছর বয়সী বিধবা উম্মে বেরকিসও তার চার ছেলের জন্য ঈদে প্লাস্টিকে বানানো যুদ্ধসামগ্রীর খেলনা কিনে দিতে রাজি হননি। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে তিনি বলেন, ‘অস্ত্র আমাদের শহরকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং আমাদের শিশুদের আহত করেছে। এ বছর খেলনা পিস্তল কেনার কোনও প্রশ্নই আসে না। সহিংসতাকে মনে করিয়ে দেয় এমন যেকোনও কিছুকেই আমরা ঘৃণা করি।’ বেরকিসের মতোই নিজ এলাকায় খেলনা পিস্তলের অস্তিত্ব দেখতে চান না ৩৫ বছর বয়সী আলি মোয়াইদ। তিনি বলেন, ‘খেলনা পিস্তল খেলাটা ভালো চিন্তা নয়, যাইহোক আমি এ বছর আমার এলাকায় একটিরও অস্তিত্ব পাইনি।’ 

উম্মে সারমাদ নামের একজন ৩২ বছর বয়সী সরকারী চাকরিজীবী বলেন, ‘আইএসের সময়কার দুঃস্বপ্নময় দিনগুলো কাটিয়ে এ বছর ঈদ করতে পারায় আমার আনন্দ লাগছে। শহরের মানুষকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরিয়ে নিতে চাইলে দুঃখকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে।’ উম্মে সারমাদ মনে করেন, আইএসের নিষেধাজ্ঞাগুলো কাটিয়ে জীবনযাত্রা আবারও স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, ‘নারীদের আর কালো নেকাবে পুরো মুখ ঢাকার বাধ্যবাধকতা নেই, পুরুষরাও আর আফগান ধাঁচের পোশাক পরতে বাধ্য নয় আর আমরা আবারও সমাধি পরিদর্শনে যেতে পারছি।’ জীবনযাত্রায় এতোটুকু পরিবর্তনেও অনেকেই খুশি। উম্মে মাহের নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘পূর্ববর্তী বছরগুলোতে ঘরে বসেই ঈদ কাটিয়েছি আমি। আর কান্না করেছি। কারণ আমি জিহাদিদের ভয় পেতাম। এ বছর আমরা মুক্ত।’