‘আগ্রাসী কণ্ঠে’ কুর্দিদের বিরুদ্ধে দমন জোরালো করার ইঙ্গিত এরদোয়ানের

তুরস্কের রবিবারের নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষিত হওয়ার পর আঙ্কারায় হাজার হাজার সমর্থকদের সামনে ভাষণ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান। সংশোধিত সংবিধানের আওতায় অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী হলেন তিনি। নিজের দল একে পার্টির প্রধান কার্যালয়ের বারান্দায় দাঁড়িয়ে উল্লসিত সমর্থকদের এরদোয়ান বলেছেন, ব্যালট বাক্সে দেওয়া রায়ে জনগণ তার সেই বাড়তি ক্ষমতার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে কুর্দিপন্থি গ্রুপগুলোর প্রতি দমননীতি জোরালো করার ইঙ্গিত দিয়েছেন এরদোয়ান। প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান ওই বিজয় ভাষণকে এরদোয়ানের ‘আগ্রাসী কণ্ঠস্বর’ আখ্যা দিয়েছে।একেপির প্রধান কার্যালয়ের বাইরে সমর্থকদের সামনে এরদোয়ান
তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থেকে ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এরদোয়ান। ২০১৬ সালের  এক 'ব্যর্থ গণঅভ্যুত্থানের' পর ২০১৭ সালে এক গণভোটে সামান্য ব্যবধানে জয়লাভ করেন তিনি। এতে সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে দেশকে প্রেসিডেন্ট শাসিত ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে রায় পান তিনি। এরদোয়ান এবারের নির্বাচনে জয়লাভ করায় দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত হবে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি সরকারি কর্মকর্তা, ভাইস প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রীদের নিয়োগ দেবেন এবং যেকোনও সময় সংসদ ভেঙে দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করতে পারবেন।

রবিবার মধ্যরাতের ভাষণে এরদোয়ান বলেন, আমাদের পতাকা আরও মুক্তভাবে উড়বে, প্রত্যেক নাগরিকের শান্তির অগ্রগতি হবে।

১৯৮০’র দশক থেকে নিজ দেশের কুর্দিপন্থি সশস্ত্র দল কুর্দিস্তান ওয়ার্কাস পার্টিকে (পিকেকে) সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে থাকে তুরস্ক। পিকেকে ও সিরিয়ার কুর্দিপন্থী দল ওয়াইপিজে তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা এবং সিরিয়ার অংশ বিশেষ নিয়ে আলাদা কুর্দিস্তান রাষ্ট্রগঠনের লক্ষ্যে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে আসছে। পিকেকে ও ওয়াইপিজেকে হটাতে এরদোয়ানের নেতৃত্বে গত বছরের আগস্টে সিরিয়া যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে তুরস্ক। সেদেশে কুর্দিদের অবস্থান লক্ষ্য করে হামলা চালায় তুর্কি সেনাবাহিনী। রবিবারের বিজয় ভাষণে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি পুর্নব্যক্ত করে এরদোয়ান ‘সিরীয় ভূমিকে আরও মুক্ত করতে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার’ কথা বলেন।

বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে কুর্দি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছেন এরদোয়ান। অভিযোগ আছে রবিবারে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কুর্দি দলগুলোর প্রচারণায় বাধা দিয়েছে তার প্রশাসন। এছাড়া পদ্ধতিগতভাবে কুর্দিদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকেও বিরত রাখার চেষ্টা হয়েছে। জুনের প্রথমদিকে এক সমর্থক ভুলবশত অনলাইনে এরদোয়ান ও সংসদীয় কর্মকর্তাদের বৈঠকের এক ভিডিও ফাঁস করে দেন। ওই ভিডিওতে এরদোয়ান কর্মকর্তাদের কুর্দি ভোটারদের ভোটদানে বিরত রাখার নির্দেশ দেন। ভিডিওতে তাকে ব্যালট বাক্স পর্যবেক্ষক কমিটির সদস্যদের বলতে শোনা যায়, আমি এসব কথা বাইরে বলতে পারি না… নির্বাচনে যদি কুর্দিপন্থি দল এইচডিপির ভরাডুবি ঘটে তাহলে আমরা আরও ভালো অবস্থানে যাবো…আপনারা জানেন তারা কারা। আপনারা প্রতিটা ব্যালট বাক্সের ভোটার তালিকা নিয়ে নিয়ে এই বিশেষ কাজ করবেন।

কুর্দি সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা কমানো হয়েছে। এইচডিপির এক নেতাকে প্রশ্নবোধক ‘সন্ত্রাসী প্রচারণা’ চালানোর অভিযোগে নির্বাচনের আগে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আটক, জরিমানা, এমনকি কারাগারে পাঠানো হয়েছে শত শত কুর্দি প্রার্থীকে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কুর্দি সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় নির্বাচনে অনেক অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন। এতসব দমনপীড়ন সত্ত্বেও কুর্দিপন্থি হালকারাম ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এইচডিপি) রবিবারের নির্বাচনে ১১ দশমিক ০৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে।  প্রধান দুই জোটের কোনোটির শরিক না হয়েও সাংসদ নির্বাচিত হয়েছে ৬৭ জন এইচডিপি সদস্য।

মধ্যরাতের বিজয় ভাষণে ‘আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি’ বৃদ্ধিরও অঙ্গীকার করে এরদোয়ান বলেন, তুরস্কের নষ্ট করার মতো এক মুহূর্ত  সময় নেই, আমরা তা জানি। এর আগে রবিবার মধ্যরাতে তুরস্কের নির্বাচনি বোর্ড জানায়, ৯৭.৭ শতাংশ ব্যালট গণনা শেষে এরদোয়ান ৫০ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে প্রার্থীকে অবশ্যই ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেতে হয়। পরে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আনাদোলু এজেন্সি জানায়, গণনাকৃত ৯৯ শতাংশ ব্যালটে এরদোয়ান ৫২.৫৪ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বি সিএইচপির প্রার্থী মুহাররম ইনজে পেয়েছেন ৩০.৬৮ শতাংশ ভোট।

ফলাফল ঘোষণার আগেই জয়ের ইঙ্গিত পেয়েই এরদোয়ান বলেন, জনগণ আমাদের প্রেসিডেন্সিয়াল আর নির্বাহী পদগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, আশা করবো গণতন্ত্রকে নস্যাৎ আর ফলাফলে নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে কেউ এই নির্বাচনের ওপর ছায়া ফেলতে পারবে না। ফলাফল ঘোষণার পর তাৎক্ষণিকভাবে পরাজয় স্বীকার করে নেয়নি প্রধান বিরোধী দল সিএইচপি। অবশ্য এর আগে তারা জানিয়েছিল, ফলাফল যাই হোক গণতান্ত্রিক লড়াই অব্যাহত রাখবে তারা।