রাশিয়া ও ইরান সমর্থিত সরকারি বাহিনীর ধারাবাহিক হামলা থেকে বাঁচতে আসাদ সরকারের সঙ্গে আত্মসমর্পণ চুক্তিতে বাধ্য হলো সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় ডেরা প্রদেশের বিদ্রোহীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিরিয়ান আরব নিউজ এজেন্সি সানা জানিয়েছে শুক্রবার রাশিয়ার মধ্যস্থতায় এই চুক্তিতে পৌঁছাতে সক্ষম হয় দুই পক্ষ। চুক্তিতে অসম্মত বিদ্রোহীদের ইদলিব প্রদেশে পাঠিয়ে দিতে সম্মত হয় তারা। এএফপি জানিয়েছে, চুক্তির ফলে ডেরায় সহিংসতার নিরসন হলেও আশপাশের অঞ্চলে এখনও ভারী বোমাবর্ষণ চলছে। চুক্তির ফলে ডেরার প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা এখন আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণে। বিদ্রোহীদের প্রাণকেন্দ্র ডেরার প্রতিকী গুরুত্বের কথা তুলে ধরে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণ চুক্তির মধ্য দিয়ে আসাদ সরকারের অবস্থান আরও সুসংহত হলো। জাতিসংঘ বলছে, ১৯ জুন থেকে ডেরায় শুরু হওয়া হামলার কারণে বাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার বাসিন্দা। সিরিয়ান অবজারভেটরি বলছে এই হামলায় প্রাণ হারিয়েছে অন্তত দেড়শো মানুষ।
আট বছর ধরে চলা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে জর্ডান ও ইসরায়েলের দখলকৃত গোলান উপত্যকার সীমান্তবর্তী ডেরা প্রদেশে অবস্থান সংহত করতে গত ১৯ জুন রাশিয়া আর ইরানের সমর্থনে হামলা শুরু করে আসাদ সরকার। দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে বিমান ও স্থল হামলার পর সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে সম্মত হলো বিদ্রোহীরা। এর আগে গত বুধবার আরেক দফা চুক্তির প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়। সানার খবরে বলা হয়েছে, এই চুক্তির আওতায় বিভিন্ন শহর আর নগরের বিদ্রোহীরা তাদের ভারী ও মধ্যপাল্লার অস্ত্র সমর্পণ করবে। চুক্তিতে রাজি না হওয়া বিদ্রোহী ও তাদরে পরিবারের সদস্যদের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ইদলিব প্রদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এছাড়া চুক্তির আওতায় সিরিয়া-জর্ডান সীমান্তের সবগুলো চেকপোস্টের নিয়ন্ত্রণ সিরিয়ার সরকারি বাহিনী নিয়ে নেবে। সানার এই খবর প্রকাশের কয়েক ঘণ্টা আগে জর্ডানের খুবই গুরুত্বপূর্ণ নাসিব সীমান্ত পোস্টের নিয়ন্ত্রণে নেয় সরকারি বাহিনী।
সিরিয়ার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী ব্রিটিশ মানবাধিকার গ্রুপ সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস বলেছে, পাশ্ববর্তী কুনিয়েত্রা ও সেইদা প্রদেশে বিদ্রোহীদের ওপর আসাদ বাহিনীর হামলা অব্যাহত রয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে শুধুমাত্র ডেরা প্রদেশের জন্য।
ডেরার ৩০টিরও বেশি শহরের বিদ্রোহীরা একই ধরণের চুক্তিতে পৌঁছাতে সম্মত হয়েছে। এতে করে প্রদেশটিতে আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রিত এলাকার আয়তন আগের তুলনায় দ্বিগুণ বেড়েছে। এএফপি বলছে, এখন ডেরার প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ আসাদ সরকারের হাতে। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত চুক্তির আওতায় বিদ্রোহীদের ভারী ও মধ্যপাল্লার অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে সরকারি বাহিনী। স্থানীয় পুলিশ এসব এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে আর সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম আবারও শুরু করবে।
চলতি বছরে রাজধানী দামেস্কের নিরাপত্তা সংহত করার পর প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ গত মাসে দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকায় অভিযান শুরু করেন। নাসিবের নিয়ন্ত্রণ ঘোষণার আগে সিরিয়ার শাসক বাহিনী সেদিকে দ্রুত অগ্রসর হয়। সিরিয়ান অবজারভেটরি বলছে, আশেপাশের শহরগুলোতে প্রচন্ড বোমাবর্ষণ আর বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ইতিমধ্যে সীমান্তের তিন কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে গেছে আসাদ বাহিনী। বিদ্রোহীদের মুখপাত্র আবাজেদ বলেন, ডেরা শহর আর পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনা চালাতেই বুধবার দুপুর গড়িয়ে যায়। তিনি বলেন, প্রাথমিক চুক্তিতে অনুযায়ী বিদ্রোহী ও বেসামরিক নাগরিকসহ প্রায় ৬ হাজার মানুষকে উত্তরাঞ্চলীয় ইদলিব প্রদেশে নিরাপদ অপসারণের কথা বলা হয়েছে।
সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস’র প্রধান রামি আবদেল রাহমান বলেছেন, রাশিয়ান বাহিনী ও সিরিয়া সরকারের বেসামরিক সীমান্ত কর্মকর্তারা কোনও ‘যুদ্ধ ছাড়াই’ নাসিব সীমান্তে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। বার্তা সংস্থা সানা জানিয়েছে নাসিব সীমান্ত পোস্টে সিরিয়ার পতাকা ওড়ানো হয়েছে। ২০১৫ সালের এপ্রিলে নাসিব সীমান্তের দখল নেয় বিদ্রোহীরা। বন্ধ হয়ে সিরীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ। এই সীমান্ত পুর্নদখলের মাধ্যমে দামেস্ক সরকার প্রতিবেশি জর্ডানের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির বিশ্লেষক নিকোলাস হেরাস বলেছেন, আসাদ সরকার ডেরা শহর আর নাসিব সীমান্ত দুটিরই নিয়ন্ত্রণ চায়। তিনি বলেন, ‘আসাদের জন্য ডেরা অতিমাত্রায় প্রতিকী কারণ সিরিয়ার বিদ্রোহের সুতিকাগার এই শহর। আর নাসিব সীমান্ত দিয়ে জর্ডানের বিনিয়োগ গ্রহণ করে আসাদ সরকার।’
গতবছর রাশিয়া, জাতিসংঘ আর জর্ডানের মধ্যস্তায় দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে সম্মত হয় বিদ্রোহী ও আসাদ সরকার। তবে তাতে ওই এলাকার সহিংসতার অবসান হয়নি। বিদ্রোহী সূত্রের বরাতে এএফপি জানিয়েছে, এর আগে এক দফায় ভারী অস্ত্র ও জনসাধারণের অপসারণের প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছিল আসাদ সরকারের অন্যতম মিত্র মস্কো।