থাইল্যান্ডের আনন্দে শামিল সারা বিশ্ব

গত ৮ জুলাই দেশি-বিদেশি উদ্ধারকারীদের সহায়তায় থাইল্যান্ডের গুহায় আটকে পড়াদের উদ্ধারে অভিযান শুরুর পর কয়েক দিন ধরে সেখানেই আটকে ছিল বিশ্বের চোখ। চলছিলো নানা উত্তেজনা ও গুঞ্জন। কী ঘটতে যাচ্ছে? আটকে পড়া শিশু ফুটবলাররা কি শেষ পর্যন্ত জীবিত অবস্থায় বের হয়ে আসতে পারবে—এমন সব প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিলো মানুষের মনে। উদ্ধার অভিযান সফলভাবে শেষ হওয়ার পর খুশিতে মাতোয়ারা থাইল্যান্ড। এ যেন এক অসম্ভবকে সম্ভব করার মিশন। থাইল্যান্ডের এ আনন্দে শামিল হয়েছে গোটা বিশ্বও। আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রগুলোতে এ অভিযানের সফলতা নিয়ে উল্লাস দেখা গেছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানরাও শিশু ফুটবলার ও উদ্ধারকারীদের অভিনন্দন জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন।

থাই শিশুরা উদ্ধার হওয়ার পর উল্লাস
গত ২৩ জুন ফুটবল অনুশীলন শেষে ২৫ বছর বয়সী কোচসহ ওই ১২ কিশোর ফুটবলার গুহাটির ভেতরে ঘুরতে গিয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টিতে গুহার প্রবেশমুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা আর বের হতে পারেনি। রবিবার (৮ জুলাই) থাইল্যান্ড সরকার শিশুদের উদ্ধারে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় উদ্ধার অভিযান শুরু করে। তিন দিনের সফল অভিযানে উদ্ধার হয় কোচসহ ১২ খুদে ফুটবলার।

থাইল্যান্ডের ইংরেজি দৈনিক ব্যাংকক পোস্ট ও দ্য নেশন গত এক সপ্তাহ ধরেই এ উদ্ধার অভিযানের খবরকে প্রথম পাতায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করে আসছে। মঙ্গলবার অভিযান শেষ হওয়ার পর বুধবার দুটি সংবাদপত্রই মিশনের সফলতায় উল্লাস প্রকাশ করে শিরোনাম করেছে। দ্য নেশনের শিরোনাম ছিল: ‘হুয়া! মিশন অ্যাকমপ্লিশড’ (হুয়া! অভিযান শেষ হলো)। ব্যাংকক পোস্টের শিরোনাম ছিল: ‘অল ওয়াইল্ড বোয়ার্স সেভড’ (ওয়াইল্ড বোয়ার্স দলের সবাই এখন নিরাপদ)। মূল খবরের পাশাপাশি তারা উদ্ধার অভিযানের সময় পরিক্রমা ও একজন উদ্ধারকারীর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। তাছাড়া উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য প্রযুক্তি উদ্যোক্তা এলন মাস্কের পক্ষ থেকে মিনি-সাবমেরিন পাঠানোর প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়া নিয়েও সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে।

থাইল্যান্ডের গুহায় উদ্ধার অভিযানে সহায়তার জন্য চিকিৎসকসহ উদ্ধারকারীদের ১৯টি দল পাঠিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। এ চিকিৎসকই গুহার ভেতরে থাকা শিশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছেন। থাইল্যান্ডের গুহার অভিযান সফল হওয়ার উচ্ছ্বাসটা বেশ জোরালোভাবেই প্রকাশ পেয়েছে অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে। অনেক সংবাদপত্রই প্রথম পাতায় সংবাদটি প্রকাশ করেছে। ক্যানবেরা টাইমস শিরোনাম করেছে ‘দ্য গ্রেট এসকেপ’ (বড় বাঁচা)। সিডনি মর্নিং হেরাল্ড গুহায় আটকে পড়া শিশু ফুটবলারদের একটি রঙিন ছবিযুক্ত প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে: ‘দে আর অল আউট’ (ওরা সবাই এখন বাইরে)।

দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের প্রথম পাতা
জার্মানিভিত্তিক সংবাদমাধ্যম স্পিগেল অনলাইন এ উদ্ধার অভিযানের নাম দিয়েছে ‘লিবারেশন ফ্রম দ্য ডিপ’ (গভীরতা থেকে পাওয়া মুক্তি)। তবে দেশটির আরেক সংবাদমাধ্যম লা মন্ডে আরও বেশি তথ্যবহুল ও নাটকীয় শিরোনাম করেছে। তারা লিখেছে, ‘থাইল্যান্ড: আফটার মোর দ্যান টু উইকস আন্ডারগ্রাউন্ড, দ্য থার্টিন কেভ সার্ভাইভার্স হ্যাভ বিন ইভ্যাকুয়েটেড’ (থাইল্যান্ড: দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকার পর, গুহা থেকে ১৩ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে)। ড্যানিশ অনলাইন সংবাদমাধ্যম দ্য লোকাল তাদের সাইটে থাইল্যান্ড অভিযান সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রকাশ করেছে। এর শিরোনাম হলো, ‘অ্যাম্বাসেডর প্রেইজেস ড্যানিশ ডাইভারস ফর রোল ইন থাইল্যান্ড কেভ রেসকিউ’ (থাইল্যান্ডের গুহা থেকে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া ড্যানিশ ডুবুরিদের প্রশংসায় রাষ্ট্রদূত)।

ব্রিটিশ ডুবুরিরা অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও অভিযানের শেষ দিনে মঙ্গলবার (১০ জুলাই) যুক্তরাজ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু তৈরি হয়। এদিন পদত্যাগ করেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন। তাছাড়া ইংল্যান্ড দলের বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনালে যাওয়ার লড়াই নিয়েও সংবাদ রয়েছে। সব মিলে থাই অভিযানের খবরটি ব্রিটিশ সংবাদপত্রে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। তবে খবরটিকে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করা হয়েছে। দ্য গার্ডিয়ানের প্রথম পাতার প্রধান শিরোনামগুলোর একটি ছিল থাই অভিযান। প্রতিবেদনটির শিরোনাম দেওয়া হয়েছিল: ‘সেলিব্রেশন অ্যাজ থাইল্যান্ড রেসকিউস অল টুয়েলভ কেভ বয়েজ’ (থাই গুহায় আটকে থাকা ১২ শিশুর সবাই উদ্ধার হওয়ার পর উদযাপন)। দ্য টাইমস-এর শিরোনাম হলো- ‘জুবিলেশন অ্যাজ অল টুয়েলভ বয়েজ ফ্রিড ফ্রম থাই কেভ’ (থাই গুহা থেকে ১২ শিশুর সবাইকে উদ্ধারের পর জয়ধ্বনি)। আর আরেক ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম মেট্রো শিরোনাম করেছে- ‘লাকি থার্টিন’।

দ্য গার্ডিয়ানের প্রথম পাতা
সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুটি ইংরেজি দৈনিকই তাদের প্রথম পাতায় থাইল্যান্ডের অভিযানের খবরটিকে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করেছে। দ্য গালফ টুডে’র শিরোনাম হলো: ‘অল থার্টিন ট্র্যাপড ইন থাই কেভ রেসকিউড’ (থাই গুহায় আটকে পড়া ১৩ জনের সবাই উদ্ধার)। খালিজ টাইমস শিরোনাম করেছে: ‘হুররে! সকার কিডস আর ফাইনালি ব্যাক ফ্রম কেভ’ (হুররে! শিশু ফুটবলাররা অবশেষে গুহা থেকে ফিরলো)।

মঙ্গলবার (১০ জুলাই) অভিযান শেষ হওয়ার পর মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন তাদের সাইটে একটি ব্যানার শিরোনাম করে। সেখানে লেখা হয়: ‘দে আর অল আউট’ (তারা সবাই এখন বাইরে)।

উদ্ধার অভিযান সফলভাবে শেষ হওয়ার পর পরই অভিনন্দন জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইটার পেজে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছে। তিনি লিখেছেন: ‘খুব সুন্দর একটি মুহূর্ত। সবাই মুক্ত হয়েছে, দারুণ!’

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে, আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্যাট্রিন জ্যাকবসদোত্তির ও সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লী সেইন লুং-ও উদ্ধারকারীদের অভিনন্দন জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেলের মুখপাত্র স্টিফেন সেইবার্ট তার টুইটে বলেন, ‘সাহসী কিশোর ও তাদের কোচ এবং তাদের যারা উদ্ধার করেছে তাদের অনেক প্রশংসা করতে হয়। টুইটারে দেওয়া পোস্টে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বলেন, ‘থাইল্যান্ডে সবাই উদ্ধার হয়ে যাওয়ায় আমরা খুবই খুশি। সারা বিশ্ব এ ঘটনায় নজর রেখেছিল। তাদের সাহসকে শ্রদ্ধা জানাই।’ যুক্তরাজ্যের ক্লাব ফুটবল দল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থাই কিশোর ফুটবল দল ও তাদের উদ্ধারে কাজ করা সবাইকে ‘ওল্ড ট্রাফোর্ড’ স্টেডিয়ামে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

এদিকে উদ্ধার হওয়া শিশু ফুটবলারদের সবাইকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে হাসপাতালে তাদের আলাদা করে রাখা হয়েছে। সাতদিন পর্যন্ত এভাবে তাদের রাখা হবে। উদ্ধার হওয়া শিশু ও তাদের কোচের দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠাকে এখন প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।