কিশোরদের উদ্ধারে জীবন উৎসর্গকারী সেই ডুবুরি

গায়ে ধূসর এক টি-শার্ট। চোখের চশমায় নীল আভা। থাই নেভির সাবেক ডুবুরি সামারান কুনান এই পোশাকেই নিজের শেষ ভিডিওচিত্র প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘থাম লুয়াং, আজ রাতে দেখা হচ্ছে।‘ প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন তিনি। গুহায় ঢুকেছিলেন আটকেপড়া কিশোরদের উদ্ধার করতে। ঠিকই বের হয়ে এসেছে কিশোররা। কিন্তু কুনান আর বের হতে পারেননি। উদ্ধার অভিযানের একমাত্র বিয়োগান্তক ঘটনা হয়ে চলে গেছেন জীবনের ওপারে। কিশোরদের জন্য অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করতে গিয়েই আত্মাহুতি দিয়েছেন কুনান। অক্সিজেনের অভাবেই প্রাণ হারিয়েছেন তিনি। উদ্ধার অভিযানের সফলতায় সারা বিশ্ব আনন্দে উল্লসিত হলেও সংশ্লিষ্টদের কেউই কুনানের কথা ভোলেননি। শোকাতুর বাস্তবতা পার করে এসেছে উদ্ধার হওয়া কিশোররা। থাই নৌবাহিনী তাকে সম্মান জানাতে প্রস্তুত। স্ত্রী তার শূন্যতায় কাতর। বিশ্ববাসী জানিয়েছেন নতজানু শ্রদ্ধা।

উদ্ধার অভিযানে নিহত ডুবুরি সামারান কুনান

গত ২৩ জুন ফুটবল অনুশীলন শেষে ২৫ বছর বয়সী কোচসহ ওই ১২ কিশোর ফুটবলার থাম লুয়াং গুহাটির ভেতরে ঘুরতে গিয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টিতে গুহার প্রবেশমুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা আটকা পড়ে। টানা ৯ দিন নিখোঁজ থাকার পর গত ২ জুলাই গুহার ভেতরে জীবিত অবস্থায় ১২ কিশোর ফুটবলারসহ তাদের কোচকে শনাক্ত করেন ডুবুরিরা। থাই নৌবাহিনীর সাবেক সদস্য সামারান কুনান তাদের খোঁজে শুরু হওয়া অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন ১ জুলাই। ৫ জুলাই (বৃহস্পতিবার) মধ্যরাতে অভিযান চলার সময় অক্সিজেন স্বল্পতায় পড়েন কুনান। নেভিসিল কমান্ডার জানান, আটকেপড়া শিশুদের বের করে আনতে চলমান অভিযানের অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার রাতে গুহায় অক্সিজেনের ট্যাঙ্ক বসানো হচ্ছিলো। সেখানেই কাজ করছিলেন ৩৮ বছর বয়সী সামান কুনান। তবে অক্সিজেনের লাইন টানার সময় নিজেই অক্সিজেন স্বল্পতায় পড়ে অচেতন হয়ে পড়েন। শুক্রবারের প্রথম প্রহরেই তিনি মারা যান।

থাম লুয়াংয়ের উদ্দেশে রওনা হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করতে হয় তারা। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি এই সামগ্রিক উদ্ধার অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন। গুহার ভেতরে অক্সিজেন ট্যাংক বসানোর সময় অচেতন হয়ে পড়েন তিনি। সঙ্গীরা বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলেও তার জ্ঞান ফেরানো সম্ভব হয়নি বলে জানান সিল ইউনিট। সামারান ভিডিওতে বলেছিলেন, ‘আমরা ফ্রগস টিমকে (থাই নৌবাহিনীর ডাকনাম) সহায়তা করছি। আমাদের সঙ্গে চিকিৎসক ও ডুবুরিরা আছেন। তারপরও শেষরক্ষা হয়নি। প্রাণ দিতে হয় সামারানকে। নেভি সিল তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে তারা জানিয়েছে, ‘সে একজন ক্রীড়াবিদ ছিল। খেলা পছন্দ করতো। নেভি যে অভিযানই চালাক না কেন, সামারান সবসময়ই ঝাঁপিয়ে পড়তো। জীবনের শেষটুকু দিয়ে হলেও।’

উদ্ধার অভিযানে নিহত ডুবুরি সামারান কুনান

২০০৬ সালে নৌবাহিনী ছেড়ে ব্যাংককের সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরে উদ্ধারকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন সামারান কুনান। ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে তার ছবি দেখলে মনে হবে তিনি বোধহয় একজন সাইক্লিস্ট। সবসময় পাহাড়ে সাইক্লিং করে বেড়ানো ছবি দিতে থাকেন। বুধবার এক পোস্টে সামারান কয়েকজন উদ্ধারকারীর সঙ্গেও ছবি আপলোড করেছিল। গুহার ভেতরের ছবিও ছিল সেখানে। নৌবাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল চেত্তা জায়পিয়েম বলেন, সামারানকে সম্মান জানাতে ও সবার সামনে তুলে ধরতে বিশেষ অনুমতি নেবে নেভি। অবসরের আগে পেটি অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। থাইল্যান্ডে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত গ্লিন টি ডেভিসও সামারানের পরিবারের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, মার্কিনিদের পক্ষ থেকে আমি সাহসী এই দেশপ্রেমিকের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।’

উদ্ধার অভিযানের নেতৃত্বে থাকা চিয়াং রাই’র ভারপ্রাপ্ত গভর্নর নারোংসাক ওসোটানাকর্ন উদ্ধার অভিযানের শেষ দিনে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সামারানের মৃত্যুর দিনে কিশোর ফুটবলারদের ওই পুরো দল শোকাহত ছিল। তবে সেই শোককে আমরা শক্তি বানিয়েছি। জীবন বাঁচাতেই তিনি জীবন দিয়েছেন। সামারান প্রকৃত বীর। বিশ্ব তাকে মনে রাখবে।’ থাই সংবাদমাধ্যম জানায়, শনিবার শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হবে সামারানের। সেজন্য ১৫ বর্গমিটারের একটি স্থান তৈরি করা হয়েছে। অংশগ্রহণকারীদের জন্য বাস সুবিধা দিচ্ছে স্থানীয় বাস প্রতিষ্ঠানগুলো।

dwvkbn5f9au_samarn-kunan-reuters-650_625x300

সামাজিক মাধ্যমে সামারানের জন্য আর্তি প্রকাশ পেয়েছে তার স্ত্রীর। তিনি  জানিয়েছেন, স্বামী ছিলেন তার পরম ভালোবাসার মানুষ। তাকে হারিয়ে শূন্যতা অনুভব করছেন। তবে এ ঘটনার জন্য গুহা থেকে উদ্ধার হওয়া কিশোর ফুটবল দলের সদস্যদের দোষারোপে রাজি নন নিহত ডুবুরির স্ত্রী। ছবি শেয়ারিংয়ের সামাজিক মাধ্যম ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা এক ছবির ক্যাপশনে এসব কথা জানিয়েছেন তিনি। এতে সাড়া দিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। নিহত ডুবুরির বীরোচিত ভূমিকা স্মরণ করে তার স্ত্রীর জন্য শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন বিশ্ববাসী।

সিঙ্গাপুর থেকে একজন সামারানকে উদ্দেশ করে লিখেছেন, ‘আপনাকে আলিঙ্গন, আপনিই নায়ক।’ যুক্তরাষ্ট্রের একজন ব্যবহারকারী বলেন, ‘আপনার এই ক্ষতিতে ব্যথিত। বিশ্বই যেন শূন্যতা অনুভব করছে। আপনার স্বামী একজন নায়ক। যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনেক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।’ অসি (১৪) নামের অস্ট্রেলীয় এক নাগরিক কমেন্ট করে, ‘আপনার স্বামী শান্তিতে থাকুক। তার এই স্মৃতি অমর হয়ে থাকবে। সারা বিশ্বের মানুষের জন্য তিনি ‍দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন।’