নওয়াজবিরোধী অবস্থানে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী!

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্পর্কের টানাপড়েন আজকের নয়। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান পারভেজ মুশাররফকে বরখাস্ত করার মধ্য দিয়ে এই টানাপড়েন স্পষ্ট হয়। মার্চে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক নওয়াজকে প্রধানমন্ত্রিত্বের অযোগ্য ঘোষণা করার পর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সেনাবাহিনীর নওয়াজবিরোধী অবস্থানের কথা উঠে আসে। সে সময় জানা যায়, বিচার বিভাগের ওই ভূমিকাকে অকুণ্ঠ সমর্থন জুগিয়েছে সেনাবাহিনী। অল্প কিছুদিনের মাথায় নওয়াজ শরিফের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে সেনাবাহিনীর রোষের মুখে পড়ে দেশটির সবচেয়ে প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ডন। সবশেষ দুর্নীতির মামলায় সাজা ঘোষণার পর দেশে ফিরেও সেনাবাহিনীর রোষের শিকার হয়েছেন নওয়াজ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিরাপত্তা সূত্রের বরাতে ফার্স্টপোস্টের প্রতিবেদক উমর আলী জানিয়েছেন, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা বিভাগের পক্ষ থেকে নওয়াজের দলীয় সমাবেশে বাধা সৃষ্টি ও নেতাকর্মীদের ওপর গ্রেফতার-নিপীড়ন চালাতে বলা হয়। বিশ্লেষকরাও সেনাবাহিনীর ভূমিকায় নওয়াজবিরোধী অবস্থান শনাক্ত করেছেন।

noname

১৯৯৯ সালে সেই সময়কার সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মুশাররফকে বরখাস্ত করেছিলেন নওয়াজ শরিফ। এরপর বদলা হিসেবে পারভেজ মুশাররফের নেতৃত্বাধীন এক সেনা অভ্যুত্থানে নওয়াজ ক্ষমতাচ্যুত হন। আর তার প্রতিশোধ নিতে ২০১৩ সালে ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় পারভেজ মুশাররফকে বিচারের মুখোমুখি করেন নওয়াজ। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে নওয়াজের দলের সম্পর্ক তাই ঐতিহাসিকভাবেই তিক্ত।

পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারির ঘটনায় নাম থাকায় পরিবারের সম্পদ নিয়ে তদন্তের পর গত বছরের জুলাই মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। অপ্রদর্শিত সম্পদের কারণেই সুপ্রিম কোর্ট পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ বা পিএমএল-এন’র নেতা নওয়াজের বিরুদ্ধে রায় দেন। রায়কে পক্ষপাতদুষ্ট আখ্যা দেয় নওয়াজের দল। তবে প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ডন সে সময় জানায়, নওয়াজবিরোধী অবস্থান থেকেই গত মার্চে নির্দিষ্ট কিছু সাংবাদিককে ডেকে নিয়ে ব্রিফিং করেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া। রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতরে ওই ব্রিফিংয়ে অন্তত ৩০ জন সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, টিভি উপস্থাপক ও সংবাদমাধ্যমের মালিক উপস্থিত ছিলেন। সেখানে উপস্থিত থাকা একজন জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে এশিয়া টাইমস’কে সে সময় জানিয়েছিলেন, সেনাপ্রধান সোজাসুজিভাবে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন।

ওই বিশ্লেষক জানিয়েছিলেন, সাধারণত কোনও বাহিনীর সদস্যরা যেসব বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে পছন্দ করেন না তিনি (সেনাপ্রধান) ওইসব বিষয় নিয়েই নিজের মতামত বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। ওই বিশ্লেষক আরও বলেছিলেন, সেনাপ্রধান সরকারের বিচার বিভাগবিরোধী প্রচারণার বিরোধিতা করেছেন। তার মতে, এতে শুধু দেশের ক্ষতিই হবে। সেনাপ্রধানকে উদ্ধৃত করে বিশ্লেষক বলেন, ‘বিচার বিভাগে অস্থিতিশীলতা বা এর রায়ের প্রতি কটাক্ষ করা হলে তা আমাদের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফেলতে পারে। যারা সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তে রাগ করবেন, তাদের বিচার বিভাগকে হেয় করা বা সম্মানিত বিচারকদের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেওয়া হবে না।’
মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে নওয়াজ শরিফের এক সাক্ষাৎকারের বিষয়ে নাখোশ হয়ে পাকিস্তানের শীর্ষ দৈনিক পত্রিকা ডন’র প্রচারও বাধাগ্রস্ত করছে সেনাবাহিনী। এ ঘটনাকে ‘পাকিস্তানে সাংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপের সর্বশেষ নজির’ হিসেব আখ্যায়িত করেছে সাংবাদিকদের সুরক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’-আরএসএফ। ওই সময় পাকিস্তানের প্রেস কাউন্সিল ডনকে দেওয়া এক নোটিশে দাবি করেছে, ডন ‘নৈতিকতাবিরোধী’ এমন খবর প্রকাশ করেছে, যাতে ‘পাকিস্তান বা পাকিস্তানের জনগণকে দায়ী করার বা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অভিযোগ উত্থাপিত হতে পারে।’
সাংবাদিকদের সঙ্গে জেনারেল বাজওয়ার মার্চের বৈঠক সম্পর্কে ইসলামাবাদভিত্তিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ড. ফারুখ সালিম এশিয়া টাইমসকে বলেছিলেন, পাকিস্তানে এখন ত্রোইকা’ (তিনটি ঘোড়ায় টানা একটি যানবাহন) ধারণাটি কাজ করছে। আগে বিভিন্ন অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত সামরিক বাহিনী এখন বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ঢুকতে চাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনও শূন্যতা তৈরি হয়, তখনই ত্রোইকার শক্তিশালী অংশটি (সেনাবাহিনী) কার্যকর হওয়া শুরু করে’।
এশিয়া টাইমস’র সূত্র মার্চে সাংবাদিকদের সঙ্গে সেনাপ্রধানের বৈঠক প্রসঙ্গে বলেছিল, ব্রিফিংয়ে দেশের সংবিধান অনুযায়ী আইন সব নাগরিকের জন্য সমান হবে বলে উল্লেখ করেছিলেন সেনাপ্রধান বাজওয়া। তিনি বলেছিলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের বেসামরিক ও সামরিক শীর্ষ ব্যক্তিরা বিশেষ সুবিধা ভোগ করে আসছে। এ কারণে দেশে খারাপ শাসন ও অন্যায্যতা বিরাজ করছে। যদি দেশকে বিশ্বের মধ্যে সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যেতে হয় তাহলে এ অবস্থা ঠেকাতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এতদিন দেশের আইন চলেছে কিন্তু আইনের শাসন চলেনি’।

লন্ডনে কেনা বিলাসবহুল চারটি ফ্ল্যাটের মূল্য পরিশোধে দেওয়া অর্থের উৎস দেখাতে ব্যর্থ হওয়ার দায়ে ৬ জুলাই নওয়াজ শরিফ আর তার মেয়ে মরিয়মকে কারাদণ্ড দেয় আদালত। রায় ঘোষণার সময় লন্ডনে অবস্থানরত পিতা ও কন্যা শুক্রবার দেশে ফিরেই গ্রেফতার হন। নাম প্রকাশ না করা শর্তে একজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ ও নওয়াজের নিজের নির্বাচনি এলাকা পাঞ্জাবের পুলিশ কর্মকর্তাদের সামরিক ও গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে পিএমএল-এন নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া দলটির বিভিন্ন কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

গত কয়েক দিন ধরে নওয়াজ সেনা নেতৃত্বকে আক্রমণ করে কথা বলেছেন। তিনি তাদের খালাই মাখলুক বা ভিনগ্রহের প্রাণী হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। তবে প্রথমবারের মতো লন্ডনের সংবাদ সম্মেলনে তিনি গোয়েন্দা বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করেন। ওই কর্মকর্তা পিএমএল-এন‘র নির্বাচনি প্রার্থীদের নির্বাচন না করার অথবা দলীয় আনুগত্য পরিবর্তনের জন্য চাপ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন নওয়াজ।

সাংবাদিক ও বেসামরিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনকর্মী গুল বুখারি মনে করেন, নওয়াজের দল পিএমএল-এন’কে রুখতে সেনাবাহিনীর অব্যাহত প্রচেষ্টা জারি রয়েছে। আরেক স্বনামধন্য সাংবাদিক ও বিশ্লেষক মুবাশি জাইদিও মনে করেন, দলটি এখন সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে ভয়ঙ্কর চাপের মুখে আছে। তিনি বলেছেন, পিএমএল-এন যাতে ৫০টির বেশি আসন না পায় তা নিশ্চিত করতে তারা (সামরিক নেতৃত্ব) এমন কিছু নেই যা করেনি।